ধেয়ে আসছে ভয়ঙ্কর সৌরঝড় (সোলার স্টর্ম)। ঝড়ের তাণ্ডবে ভেঙে পড়তে পারে গোটা বিশ্বের যাবতীয় ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা। আর তা বেশ কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসও স্থায়ী হতে পারে।
আমেরিকার আরভিনে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক একটি গবেষণা এই অশনিসঙ্কেত দিয়েছে। গবেষণাপত্রটি পিয়ার রিভিউ পর্যায় পেরিয়ে এখন একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশের অপেক্ষায়।
গবেষকরা লিখেছেন, “এমন ভয়ঙ্কর সৌরঝড় বা সিএমই-র পৃথিবীর উপর আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রতি দশকে থাকে ১.৬ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ। এবার তেমনই একটি সিএমই-র ঝাপ্টা সইতে হতে পারে পৃথিবীকে। যার সম্ভাবনা খুব বেশি।”
এই ধরনের সৌরঝড়কে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘করোনাল মাস ইজেকশান (সিএমই)’। যা গোটা সৌরমণ্ডলের পক্ষেই হয়ে ওঠে অত্যন্ত বিপজ্জনক।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এ বার যে সৌরঝড় আসছে তেমন ভয়ঙ্কর সৌরঝড়ের ঝাপ্টা আধুনিক পৃথিবীকে এর আগে সইতে হয়েছিল ১৮৫৯ আর ১৯২১ সালে। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, ১০০ বছর পর ফের ভয়ঙ্কর সৌরঝড়ের মুখোমুখি হতে চলেছে পৃথিবী।
১৯২১ সালে ভয়ঙ্কর সৌরঝড় আছড়ে পড়ায় পৃথিবীর যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তা অভূতপূর্ব। বিজ্ঞানের পরিভাষায় তার নাম ‘ক্যারিংটন এফেক্ট’। সেই সৌরঝড়ের ঝাপ্টায় পৃথিবীকে ঘিরে থাকা বিশাল চৌম্বক ক্ষেত্রে বড় বড় ফাটল ধরেছিল। আর তার ফাঁক গলে ঢুকেছিল অত্যন্ত বিষাক্ত সৌরকণা আর মহাজাগতিক রশ্মি।
টেলিগ্রাফের তার সশব্দে ফেটে গিয়ে দাউদাউ করে জ্বলেছিল দীর্ঘ সময় ধরে। যে মেরুজ্যোতি (‘অরোরা’) শুধু পৃথিবীর দুই মেরুতেই দেখা যায় সাধারণত, সৌরঝড়ের প্রবল ঝাপ্টায় সে বার তা বিষুবরেখার নীচে থাকা কলাম্বিয়াতেও দেখা গিয়েছিল। খুব উজ্জ্বল ভাবে।
১৮৫৯ এবং ১৯২১ সালের মতো তীব্রতায় অতটা না হলেও ১৯৮৯ সালের মার্চে যে সিএমই ধেয়ে এসেছিল পৃথিবীর দিকে তার ঝাপ্টায় কানাডার গোটা কুইবেক প্রদেশে টানা ন’ঘণ্টা ‘ব্ল্যাক আউট’ হয়ে গিয়েছিল।
পৃথিবীর চার পাশে থাকা শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রই সৌরঝড়-সহ সূর্য থেকে ছুটে আসা নানা ধরনের হানাদারের হাত থেকে বাঁচায় আমাদের। দুই মেরুতে চৌম্বক ক্ষেত্র সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী থাকে বলে সৌরকণারা ধেয়ে এলে তাদের বেশির ভাগকেই ফিরিয়ে দেয় দুই মেরুর চৌম্বক ক্ষেত্র।
সেই সঙ্ঘর্ষেই মেরুজ্যোতির জন্ম হয়। পৃথিবী-সহ সৌরমণ্ডলের সব গ্রহের দিকেই ধেয়ে যায় এই সৌরঝড়। যে গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্র প্রায় নেই বা খুব পাতলা, নেই বায়ুমণ্ডলও সেই গ্রহকে এই ঝাপ্টা বেশি সহ্য করতে হয়।
তাই কোনও কালে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব হলেও সেখানে তা টিকে থাকতে পারেনি মঙ্গল গ্রহে। তার চার পাশে চৌম্বক ক্ষেত্রে প্রায় নেই বলে। বায়ুমণ্ডলও খুব পাতলা বলে।
মূল গবেষক, আরভিনের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঙ্গীতা আবদু জ্যোতি বলেছেন, “যেটা সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় তা হল, আমরা অতিমারির জন্য যেমন আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না এ ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটার আশঙ্কা। কারণ, সূর্যের বায়ুমণ্ডলে (করোনা) কখন ভয়ঙ্কর সৌরঝড় উঠবে তার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয় এখনও। তবে এটুকু বলা যায়, সেই ভয়ঙ্কর সৌরঝড়ের পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসতে অন্তত ১৩ ঘণ্টা সময় লাগবে।”
গবেষণাপত্রটিতে বলা হয়েছে, আধুনিক ইন্টারনেট যোগাযোগব্যবস্থার উপর এ বারের সিএমই-র আঘাত কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে সে ব্যাপারে কোনও তথ্যাদি বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। কারণ, এর আগে যখন (১৯২১) এমন ভয়ঙ্কর সিএমই পৃথিবীর উপর এসে আছড়ে পড়েছিল তখন পৃথিবীতে ইন্টারনেট ব্যবস্থাই গড়ে ওঠেনি।
গবেষকদের আশঙ্কা, এ বার যে ভয়ঙ্কর সিএমই আসছে প়ৃথিবীর দিকে তার ঝাপ্টায় সমুদ্রের নীচ দিয়ে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে যাওয়া ইন্টারনেটের যাবতীয় কেব্লই খুব ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বার্তার গতি বাড়াতে এই ইন্টারনেট কেব্লগুলিতে ৩০ থেকে ৯০ মাইল অন্তর বসানো থাকে ‘রিপিটার’। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র স্বাভাবিক না থাকলে যেগুলি বিগড়ে যায়।
একটি রিপিটার ক্ষতিগ্রস্ত হলেই ভেঙে পড়ে সেই লাইনের যাবতীয় ইন্টারনেট যোগাযোগব্যবস্থা। দেশের মধ্যে ইন্টারনেট যোগাযোগের কেব্লগুলির মতো সমুদ্রের নীচে থাকা এই কেব্লগুলি ফাইবার দিয়ে বানানো হয় না। তাই সেগুলির নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়।