জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আদায় বাড়াতে এবং করদাতাদের হয়রানি বন্ধে অটোমেশন করলেও তা পুরোদমে করতে না পারায় করদাতা ও ব্যবসায়ীদের হয়রানি কমছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা এনবিআরের অভ্যন্তরে এবং বাইরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টেকসই অটোমেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। পরামর্শ দিয়েছেন- আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র প্রদান এবং যাচাই করার জন্য সরকারের উচিত আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার একটি প্রমাণিকরণের অনলাইন সার্বজনীন (PSR) প্ল্যাটফর্ম চালু করা।
সোমবার (৩০ অক্টোবর) রাজধানীর একটি হোটেলে এসএমএসি আইটি লিমিটেড আয়োজিত ‘ট্রানজিশনিং ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স টু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম’ শীর্ষক এক গোলটেবিল সভায় তারা এসব পরামর্শ দিয়েছেন।
ব্যবসায়ী নেতা ও পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ভ্যাট রিটার্ন অনলাইনে জমা দিতে হয়। আবার অফিসে যাওয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ডিজিটাল হলেও কার্যত ম্যানুয়াল ব্যবস্থা রয়ে গেছে। এতে ব্যবসায়ীদের হয়রানি কমছে না।
ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সাবেক সভাপতি মাহমুদুল হাসান খসরু বলেন, ডিজিটাল করার উদ্দেশ্য হোক যাতে করদাতাদের কর অফিসে না যাওয়া লাগে। সেখানে গেলে আমিও (করদাতা) শেষ, আপনিও (রাজস্ব বিভাগ) শেষ। কারণ ওখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবাই ভীত। এনবিআরের উদ্দেশে তিনি বলেন, টেকনোলজি আনতে হবে, কিন্তু তা যেন জটিল না হয়। এটি বাস্তবায়ন করতে হবে ধাপে ধাপে।
এসময় তিনি ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তাদের ওপর চাপ বাড়িয়ে জিডিপিতে করের অবদান (ট্যাক্স টু জিডিপি) বাড়ানো যাবে না।
আলোচনায় অংশ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন মাসুম বলেন, আধাআধি কিংবা যৎসামান্য ডিজিটাইজেশন দিয়ে এনবিআরের উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। কর কর্মকর্তা ও করদাতার মুখোমুখি যাতে না হতে হয়, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে কর আদায়ের চাপ আরও বাড়বে, কেননা ট্যাক্স টু জিডিপি হার বাড়ানোর জন্য এনবিআরের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. মাহবুবুল আলমও তার বক্তব্যে হয়রানির প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, আমরা কর দিতে চাই হয়রানি ছাড়া। যারা কর দিচ্ছেন, বার বার তাদের ওপর চাপ বাড়ে।
তিনি বলেন, কর ফাইল জমা দেওয়ার পর একজন কর কমিশনার তা অনুমোদন দিলেন। নতুন কমিশনার আসার পর তা দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে আবার ওপেন করেন। কিন্তু এটা কার ব্যর্থতা?
অটোমেশনের কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা আয়কর, ভ্যাট দিতে চাই। কিন্তু এনবিআরের নিজস্ব অফিসের মধ্যেই বিভিন্ন বিভাগের এখনো অটোমেশন হয়নি।
এনবিআর করদাতার কাছ থেকে অগ্রিম আয়কর কেটে নেওয়ার পর তা আর ফেরত দেওয়া কিংবা সমন্বয় করছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।
ব্যবসায়ী নেতা মোহাম্মদ হাতেম এমন অভিযোগ করার পর একই প্রসঙ্গে কথা বলেছেন এফবিসিসিআই সভাপতিও। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, যদি ফেরত না দেবেন, তাহলে নিচ্ছেন কেন?
অনুষ্ঠানে এসএমএসি আইটি লিমিটেডের পরিচালক স্নেহাশিষ বড়ুয়া ডিজিটাল ব্যবস্থায় আয়কর রিটার্ন পূরণে প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত নতুন সফটওয়্যার ‘ট্যাক্সডু’ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এ পদ্ধতিতে মাত্র কয়েক মিনিটে একজন করদাতা আয়কর রিটার্ন পূরণ করতে পারবেন এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা অর্থাৎ বিকাশ, নগদ বা এ-জাতীয় সেবার মাধ্যমে করের অর্থ পরিশোধ করতে পারবেন।
অনুষ্ঠানে এনবিআর সদস্য ইকবাল হোসেন এসএমএসি আইটি লিমিটেডের এমন উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করেন এবং এ বিষয়ে এনবিআরের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহায়তা করা যায় কি না, তা বিবেচনা করা হবে বলেও জানান।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন এসএমএসিআইটি লিমিটেডের পরিচালক জেরিন মাহমুদ হোসেন। অনুষ্ঠানে অনলাইন বই ‘ট্যাক্সগুরু বিডি’ এবং ব্যক্তিশ্রেণির করদাতার আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রস্তুতি সহায়তার জন্য ‘ট্যাক্সডু অ্যাপ’ উদ্বোধন করা হয়।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে পাঠাওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম আহমেদ, অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর, বাংলাদেশ আয়কর আইনজীবি সমিতির সভাপতি মো. সোহরাব উদ্দিন, ঢাকা আয়কর আইনজীবি সমিতির সভাপতি ড. বি এন দুলাল, বিকাশের সিএফও মঈনউদ্দিন মোহাম্মদ, ব্র্যাক ব্যাংকের সিএফও মো. মাসুদ রানা, রবির হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স শাহেদ আলম, রেনেটা লিমিটেডের সিএফও মোস্তফা আলীম আওলাদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।