প্রযুক্তিতে দক্ষতার ঘাটতির সঙ্গে দেশে এখন নতুন করে যোগ হয়েছে মেধা-পাচার। স্নাতক করেই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী পাড়ি জমাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, ইউএসএ এবং কানাডায়। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরম দেখেছে, ১৫-২৯ বছর বয়সী তরুণরা দেশে থাকতে চায় না। তারা বিদেশে মাইগ্রেট করতে চায়। বিদেশে লেখাপড়তে গিয়ে ৯৮ শতাংশেই আর দেশে ফিরছেন না। যার ফলশ্রুতিতে, ২০২১ সালের গ্লোবাল ইকোনোমি প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেধা পাচারে বিশ্বের বাংলাদেশের অবস্থান ৩১তম হলেও এশিয়ায় ৪র্থ।
এই প্রতিবেদনের সুলুক সন্ধানে ২০১৮ সালে জরিপ করে সিটিও ফোরাম বাংলাদেশ দেখেছে, দূষণ,ট্রাফিক জ্যাম, দুর্নীতি এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাবের মতো নিম্ন জীবন মানের সঙ্গে জীবন ও সম্পত্তির নিরপত্তাহীনতা, মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগের অপ্রতুলতা, কম আয় এবং কর্মপরিবেশ ও চারকিরর নিরাপত্তাহীনতার কারণে তারা দেশ ত্যাগ করছে। তবে তথ্যপ্রযুক্তি দক্ষ জনশক্তি পাচার হওয়ার ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সিং, স্টার্টআপ, রিমোর্ট জবকেও এর পেছনে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন সিটিও ফোরাম ক্লাউড কনসালেন্ট মোহাম্মাদ আসিফ।
শনিবার আইসিটি দক্ষদের মেধা পাচার প্রতিরোধ নিয়ে আয়োজিত ভার্চুয়াল সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এসব বিষয় তুলে ধরেন তিনি।
তিনি বলেন, স্বল্প মেয়াদী উপর্জন বা কাজ শেখার জন্য ঠিক থাবলেও দীর্ঘমেয়াদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং কল্যাণকর নয়। একটি কাঠামোবদ্ধ পরিবেশে কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানিতে কাজ না করলে কোনো বিষয়েই দক্ষতা অর্জন করা যায় না। তাছাড়া আমাদের দেশে যারা ফ্রিল্যান্সিং করছেন তাদের প্রায় সবাই বিদেশী কোম্পানির জন্য কাজ করছেন। কিন্তু দেশের ভেতরে মিড ও এন্টারপ্রাইজ লেবেলের কোম্পানিগুলো অটোমেশন, ডিজিটাইজেশনে এই রিসোর্সগুলো পাচ্ছে না। অধিকন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় কিছু কোম্পানি বাংলাদেশে এজেন্সি খুলে বাংলাদেশী আইটি প্রোফেশনালদের নিয়োগ দিয়ে রিমোটলি কাজ করাচ্ছে।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য ব্যাঙ্গালুরের এশিয়ান সিলিকনভ্যালি কিংবা তাইওয়ান ও চায়নায় কর মওকুফ, বাসস্থান সুবিধার মতো যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তা গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে ক্যানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন সৈয়দ আক্তার হোসেন বলেন, দেশের শিক্ষকরা ডিজিটাল বাংলাদেশের অনেক উদ্যোগ সম্পর্কে সচেতন না থাকায় শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা ঘাটতি রয়েছে। দেশের ইন্ডাস্ট্রিতে শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন এবং যৌথ অংশীদারিত্ব এই ঘাটতি দূর করবে বলে মত দেন তিনি।
বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের জেনারেল সেক্রেটারি মুনির হাসান বলেন, নতুন প্রজন্মের যারা এখন দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাদের দেশে রাখতে হলে একটি ইকো সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। এজন্য প্রথাগত পেশার চেয়ে সৃজনশীলতার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা বিশ্বে এখন সৃজনশীল অর্থনীতির আকার ৩.৮ বিলিয়ন ডলার পার হয়েছে। পৃথিবীতে এখন ৫ কোটি তরুণ তাদেরকে ক্রিয়েটর বলে। এ জায়গা গুলো আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। আমরা যদি মনে করি বিটকয়েনের নাম নিলে ভাসুরের নাম নেয়া হবে; সেটা বাংলাদেশে উচ্চারণ করা যাবে না। ক্রিপ্টে কারেন্সি করলে ধরে নিয়ে যাবে তাহলে সে কেনো থাকবে? এজন্য সবাই সম্মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে।
পিএমঅ্যাস্পায়ারের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, পর্যাপ্ত দক্ষ সফটওয়্যার প্রকৌশলী পেতে এখন আমরা বেশ বেগ পাচ্ছি। আগে যেখানে ১০টি আবেদন পেতাম এখন তা ১টিতে নেমে এসেছে। কেননা এখন অধিকাংশই রিমোটলি কাজ বেড়েছে। গ্লোবাল অপারচুনিটি বাড়ায় এখন ট্যালেন্ট পেতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। ভবিষ্যতে আমাদের বাইরে থেকে প্রকৌশলী নিয়োগ করতে হচ্ছে। আমরা ইউরোপ থেকে ডিজিটাল মার্কেটিং, সেলস এর জন্য লোক হায়ার করছি। এই অবস্থার ক্ষেত্রে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ঘটাতে হবে। লেবার ল’ দিয়ে ট্যালেন্ট ধরে রাখা যাবে না।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনের হেড অব ট্যালেন্ট ম্যানেজমেন্ট আয়েশা সাঈদ কেবল ওভার টাইম দেয়া নয়, কাজের পরিবেশ ও কর্মী বান্ধব নীতি বা ব্যবস্থাপনা উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ইউজিসি ডিরেক্টর মোহাম্মাদ মাকসুদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে সামনে রেখে এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস আউটকাম বেসড এ্যডুকেশন বা ওবিই মুডে যাচ্ছে। এই মুড কার্যকর হওয়ার পর হ্যান্ডসন অ্যাপ্লিকেশনগুলো একটু চেঞ্জ হবে। ক্রেডিট আওয়ার কমিয়ে হ্যান্ডসন ও সেশনাল অ্যাপ্লিকেশন বাড়ানো হবে। আশা করি, এর মাধ্যমে অনেক ঘাটতিই মিটিয়ে পাশ্চত্যকে ছাড়িয়ে যেতে পারবো আমরা।
সভাপতির বক্তব্যে সিটিও ফোরাম সভাপতি তপন কান্তি সরকার বলেন, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অনার্স ও মাস্টার্স শিক্ষার্থীর পেছনে বছরে ৫ লাখ টাকা ব্যয় করে। সেখানে বুয়েট শিক্ষার্থীর পেছনে ১০ লাখ এবং মেডিকেল শিক্ষার্থীর পেছনে ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করেন। এটা দেশের কৃষক-শ্রমিক মেহনতি জনতার টাকা। কিন্তু মেধা পাচারের মাধ্যমে এই সুফল ভোগ করছে উন্নত বিশ্ব। ২০২০ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে ২ লাখ শিক্ষার্থী। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫ হাজার। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশই দেশে ফিরে আসে না। এটা উন্নয়নশীলতার জন্য উদ্বেগের। তাদের দেশে ধরে রাখতে না পারার জন্য বড় কারণ মেধার মূল্যায়ণের যথযথ কোনো মেথডোলজি আমাদের নেই। অথচ দেশে বিশেষজ্ঞ পরামর্শক নিয়োগে আমরা ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছি। এটা না করে ট্যালেন্ট পুল কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে কাজে লাগাতে পারে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এগিয়ে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।