ঢাকার মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান থেকে গত ২৬ এপ্রিল অপহৃত হয় ৩ বছরের এক শিশু। চকলেটের লোভ দেখিয়ে অপহরণের পর তাকে বিক্রির জন্য অনলাইনে দেয়া হয় বিজ্ঞাপন। সেই বিজ্ঞাপনের সূত্রে এক ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ হলে প্রণিল পাল নামে স্ট্যাম্প তৈরি করে দুই লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয়া হয়। তবে ২৩ দিন পর অপহৃত শিশু সিদ্দিককে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-২)। একইসঙ্গে ওই শিশুকে গোপালগঞ্জ থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছে র্যাব-২। অপহরণকারী চক্রের মূলহোতা পীযুষ দম্পতিসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-২ এর অধিনায়ক আনোয়ার হোসেন খান এসব তথ্য জানান। সংবাদ সম্মেলনে উদ্ধার করার ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেন পুলিশের এই অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক।
র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, গত ২৬ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা উদ্যানের বাসার সামনে বড় বোন হুমায়রা (৮) ও অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে খেলা করছিল শিশু সিদ্দিক। এ সময় এক অপরিচিত ব্যক্তি এসে খেলারত শিশুদের চকলেট খাওয়ায়। এক পর্যায়ে অজ্ঞাত ওই ব্যক্তি সিদ্দিককে কোলে নিয়ে বাজার থেকে আম কিনে দেবে বলে হুমায়রাকে বাসায় চলে যেতে বলে। হুমায়রা ভাইকে ছেড়ে যেতে না চাইলে তাকে ধমক দিয়ে শিশুটিকে নিয়ে চলে যায় ওই ব্যক্তি। পরে তারা ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে শিশুটিকে নিজেদের সন্তান দাবি করে সুজন নামে একজনের মাধ্যমে পল্লব কান্তি বিশ্বাস (৫২) ও তার স্ত্রী বেবী সরকার (৪৬) দম্পতির কাছে ২ লাখ টাকায় বিক্রি করে।
এদিকে, সন্তানকে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ২৭ এপ্রিল মোহাম্মদপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন দেলোয়ার। পরে ২৯ এপ্রিল এ ঘটনায় শিশুটির বাবা দেলোয়ার হোসেন শিশু ও নারী নির্যাতন আইনে মামলা করেন এবং র্যাবে অভিযোগ দেন।
আনোয়ার হোসেন খান বলেন, মামলার পর অভিযোগ পেয়ে র্যাব-২ ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে। তদন্তে সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা এবং গোয়েন্দা তথ্য ও প্রযুক্তির মাধ্যমে অপহরণকারী পীযূষ কান্তি পাল ও তার সহযোগী স্ত্রী রিদ্ধিতা পালকে শনাক্ত করা হয়। তদন্তের এক পর্যায়ে জানা যায়, শিশুটিকে অপহরণের পর সুজন সুতার নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে পল্লব কান্তি বিশ্বাস ও তার স্ত্রী বেবী সরকার দম্পতির কাছে দুই লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। পরে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর শাহবাগ থেকে সুজন সুতারকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেয়া তথ্যে গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ার তাড়াসী গ্রাম থেকে পল্লব কান্তি বিশ্বাস ও তার স্ত্রী বেবী সরকারের কাছ থেকে অপহৃত শিশু সিদ্দিককে উদ্ধার এবং ওই দম্পতিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ধারাবাহিক অভিযানে সাভার থেকে অপহরণের মূলহোতা পীযূষ কান্তি পাল ও তার স্ত্রী রিদ্ধিতা পালকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শিশু সিদ্দিককে উদ্ধারে দেরি হওয়ায় বাবা দেলোয়ার র্যাব-২ এর কাছে অভিযোগ করেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তের পর গত ১৮ মে শিশু বিক্রির সঙ্গে জড়িত সুজনকে শাহবাগ এলাকা থেকে আটক করে র্যাব।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিশু বিক্রির বিজ্ঞাপন
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে র্যাবের অধিনায়ক বলেন, পীযূষ কান্তি পাল একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ার সময় পার্টটাইম জব হিসেবে বিউটি পার্লার/স্পা সেন্টারে কাজ করতেন। ওই সময় রিদ্ধিতা পালের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে তারা ২০২০ সালে বিয়ে করেন। মূলত স্পা সেন্টারে কাজ করার সময় থেকে পীযূষ কান্তি পাল মানবপাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। গত বছরের মে মাসে মানবপাচারের অভিযোগে বনানী থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। ওই মামলায় কিছু দিন কারাগারে থাকার পর তিনি জামিনে বের হন।
এই দম্পতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘সনাতনী উদ্যোক্তা ফোরাম (এসইউএফ)’ নামে একটি গ্রুপের মাধ্যমে সন্তান বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে আসছিলেন। এই গ্রুপের মাধ্যমে আসামি সুজন সুতারের সঙ্গে আসামি রিদ্ধিতা পালের পরিচয় হয়। সুজন এই গ্রুপে শিশু দত্তক নেয়ার জন্য একটি পোস্ট দিলে রিদ্ধিতা পাল টাকার বিনিময়ে শিশু দত্তক দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
র্যাব কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন খান বলেন, গত ২১ এপ্রিল সুজন সুতারের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজের এক বছর বয়সী ছেলে প্রণিল পালের ছবি পাঠিয়ে রিদ্ধিতা পাল জানান, এই ছেলে দত্তক দেয়া হবে, আপনাদের পছন্দ হয় কি না জানান। শিশুটি তাদের বাসার স্বামী পরিত্যক্তা গৃহকর্মীর সন্তান বলে পরিচয় দেন রিদ্ধিতা। ছবি দেখে সুজন শিশুটিকে পছন্দ করে দত্তক নেবেন বলে জানান।
দুই পক্ষের কথা ঠিক হওয়ার পর পীযূষ ২৬ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা উদ্যানে এসে শিশু সিদ্দিককে চকলেট খাইয়ে অপহরণ করে সিএনজিযোগে সাভারের নিজ বাসায় নিয়ে যান। পরে রিদ্ধিতা পাল সুজনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে আগারগাঁও আইডিবি ভবনের সামনে যেতে বলেন। সেদিন বিকেলে শিশুটিকে আগারগাঁওয়ে নিয়ে রিদ্ধিতা পাল নিজেকে অর্পণা দাস ও পীযূষ কান্তি পাল নিজেকে বিজন বিহারী পাল পরিচয় দেন। এরপর একটি স্ট্যাম্পের মাধ্যমে সুজনের কাছে দুই লাখ টাকায় বিক্রি করেন এই দম্পতি। প্রমাণ হিসেবে প্রণিল পালের টিকা কার্ড, অর্পণা দাস নামে জন্মসনদ এবং বিজন বিহারী পাল নামে আইডি কার্ডের ফটোকপি দেন তারা।
গ্রেপ্তার সুজন জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তার নিকটাত্মীয় নিঃসন্তান দম্পতি পল্লব কান্তি বিশ্বাস ও বেবী সরকারের একটি সন্তানের আকাঙ্ক্ষা ছিল। পরে পীযূষ ও রিদ্ধিতা দম্পতির কাছ থেকে দুই লাখ টাকায় শিশু সিদ্দিককে কিনে তার আত্মীয়দের কাছে দেন।
এ ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান র্যাব কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন খান