ড. মুশতাক ইবনে আয়ূব
মানব সমাজে উৎসবের শুরুটা কীভাবে হয়েছিলো তার নির্দিষ্ট সূ্ত্র টানা কঠিন। তবে এর সাথে জীবনের আনন্দ, সফলতা ভাগ করে নেওয়ার যে একটা সংযোগ ছিলো সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আদিম মানুষ যখন শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো, তখন এক একটা সফল অভিযান অবধারিতভাবেই তাদের মনে আনন্দ ও সন্তুষ্টির ঢেউ বইয়ে দিতো । উৎসব ছিলো সেই আনন্দ উদযাপনের মাধ্যম। বলাবাহুল্য, জমজমাট ভোজ তখন থেকেই উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
উৎসব মোটাদাগে দুই রকমের। ঐতিহ্যগত এবং ধর্মীয়। ঐতিহ্যগত উৎসবের আবার দুটো ভাগ হতে পারে- এক অংশকে বলা যায় সাংস্কৃতিক উৎসব। আর বাকিগুলোকে একসাথে বলা যেতে প্রথাগত উৎসব।
সাংস্কৃতিক এবং প্রথাগত উৎসবগুলো জাতিসত্ত্বার স্বকীয়তার পরিচায়ক। তবে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক এবং প্রথাগত উৎসবের কিছু কিছু উপাদানে মিল পাওয়া যেতে পারে। সেটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, সংস্কৃতি এবং প্রথার আদানপ্রদান প্রায়শই ঘটে। এর মাধ্যমে মানুষের জীবনাচারণের অনেক উপাদানের মতো তাদের উৎসবেরও বিনিময় ঘটে। বিভিন্ন দিবসভিত্তিক উৎসবগুলো এভাবে একদেশ থেকে অন্যদেশে ছড়িয়ে যেতে পারে। যেমন- বাংলাদেশে সম্প্রতি পশ্চিমা বেশকিছু দিবসভিত্তিক উৎসবের প্রচলন শুরু হয়েছে। হয়তো দেশীয় সংস্কৃতি ও প্রথার মিশ্রনে উৎসবগুলো একটু পরিবর্তিত হয়ে আমাদের মূলধারায় যুক্ত হয়ে যাবে কালের প্রবাহে।
ধর্মীয় উৎসব উপরিউক্ত দুই ধরনের চেয়ে আলাদা। এর উদ্দেশ্যও ভিন্ন। ধর্মীয় উৎসবের মূল উদ্দেশ্য যার যার ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী ঈশ্বর-সন্তুষ্টি লাভ। এখানেও সামাজিক, অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন হয়। কিন্তু সেগুলো ধর্মীয় উৎসবের পার্শ্বফল। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে- এসব উৎসবের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কিছু অনুশাসন জড়িয়ে থাকে। ঐতিহ্যগত উৎসবে কিছু আচার আচরণের ব্যাপারে একটা নির্দেশনা থাকলেও সেগুলো মানা-না মানা অনেকটা ব্যক্তিগত ইচ্ছার ব্যাপার। কিন্তু ধর্মীয় উৎসবে তার সুযোগ নেই। এখানকার নিয়মকানুনগুলো নির্ধারিত এবং সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে মেনেই এসব উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ধর্মীয় উৎসব পালন করে আসছে। প্রাচীন গ্রীসে এবং অন্যান্য সভ্যতায় এ ধরনের ধর্মীয় উৎসবের বেশুমার উদাহরণ রয়েছে। ধর্মীয় বিশ্বাসের উন্মেষ, বিকাশ এবং প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ মানুষের উৎসবে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। সকল ধর্মেরই নিজস্ব উৎসব এবং তদসংশ্লিষ্ট বিধান রয়েছে।
সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে নতুন নতুন উৎসব যোগ হয়েছে, কিছু পুরনো উৎসব বিলীন হয়েছে। কিন্তু সমাজে উৎসবের উপস্থিতি নিত্যই রয়ে গেছে। এর একটা বড় দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে আধুনিক সময়ের ফিলিপিনে। সেখানে বছরের প্রতি দিন কোন না কোন উৎসব পালন করা হয়। প্রায় ৪২০০০ ছোট-বড় উৎসব উদযাপন করা হয় বছর জুড়ে।
উৎসবের উদ্ভবটা যেহেতু মানুষে মনস্তত্ত্বের সাথেই নিহিত তাই অবচেতন বা সচেতন মনে এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর।
আমাদের জীবনে উৎসব যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোধ হয় এই করোনা সংকট খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। মাসের পর মাস ঘরে থেকে কিংবা সামাজিক কোন অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দিতে না পেরে আমাদের দিন-রাত সব একাকার হয়ে গেছে। ব্যাপারটা এতটাই সঙ্গীন যে সপ্তাহের দিন, বার, তারিখ এগুলোও ঠিক খেয়াল রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। উৎসব উপলক্ষ্যগুলো ছিলো আমাদের জীবনের অবিরাম চলমান সময়ের এক একটা যতিচ্ছেদ- কোনটা ছোট, অল্প আনুষ্ঠানিকতার; কোনটা বৃহৎ আয়োজনে আড়ম্বড়পূর্ণ।
মুসলিম সমাজের জন্য সবচেয়ে আড়ম্বড়পূর্ণ উৎসব দুটি- বছরের দুই ঈদ। কিন্তু এর বাইরেও প্রতিটা শুক্রবারকে একটা বিশেষ দিন হিসেবে আলাদা করা যায়। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এক একটা শুক্রবার মুসলমানদের জন্য এক একটা ‘মিনি’ ঈদ। যেমন ধর্মীয় গাম্ভীর্য, বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতের জন্য কথাটা সত্য, তেমনি একটু বিশেষ খাবার, সমাজের আরো দশজনের সাথে দেখা-সাক্ষাত হওয়া কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের আপ্যায়ন; এসব মিলে শুক্রবারগুলো বিশেষ একটা উপলক্ষ্য- ধর্মীয় এবং সামাজিক উভয় দিক থেকেই।
ইসলামের উৎসবগুলোর একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সব মানুষকে শামিল করার একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এতে নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। শুক্রবার বেশি বেশি দান করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা, ঈদুল ফিতরের সময় (বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য) ফিতরা প্রদানের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা এবং ঈদুল আযহার সময়ে কুরবানী, যাকাত ইত্যাদি প্রদানের অনুশাসনগুলো সমাজের সবশ্রেণির মানুষকে একই আনন্দে, একই উৎসবে অবগাহন করার সুযোগ করে দেয়।
অন্যান্য ঐতিহ্যগত উৎসবের সাথে ধর্মীয় উৎসবের সাথে এখানে একটি বড় পার্থক্য। পহেলা বৈশাখ উদযাপনকালে কেউ কাউকে নতুন কিছু কিনে দিতে বাধ্য নয়, অভুক্ত প্রতিবেশিকে খাবার প্রদান করার ব্যাপারে কোন নির্দেশনা নেই। কিন্তু ঈদের উৎসবে সব কিছু নির্ধারিত। যে অভাবে আছে, যে কুরবানি করতে পারে নি, যার ঘরে খাবার নেই, তার জন্য সামর্থ্যবানদের প্রতি সুনির্দিষ্ট নিয়ম করে দেওয়া হয়েছে।
ঈদুল ফিতর কিংবা ঈদুল আযহার উৎসবের এই হচ্ছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই বিষয়টা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই মহিমান্বিত হবে ঈদ উৎসবে আমাদের মহাসম্মিলন।
লেখক : [email protected]