আমলাতন্ত্রের বাধা ডিঙিয়ে আজ থেকে ৪২ বছর আগে স্মার্ট প্রশাসক হিসেবে তাক লাগিয়েছিলেন তিনি। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের জ্ঞান ও প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়ে এই ব-দ্বীপে প্রশাসনিক কাজে কম্পিউটার, ফ্যাক্স, মুঠোফোন ব্যবহার; ইনভেন্টরি অটোমেশন, জিআইএস, এমআইএস, কম্পিউটার বিলিং এর প্রবর্তন হয়েছে তাঁর হাত ধরেই। ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট টেকনোলজির রাবার ড্যাম ব্যবহার করে আবাদি জমি- কে বন্যা-খরার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, গ্রামীণ সড়কের উন্নয়ন এবং গ্রাম-কে উন্নয়নের কেন্দ্র বিন্দুতে রূপান্তরে প্রতিটি উপজেলায় আধুনিক কমপ্লেক্স নির্মাণের মতো কাজেও মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি।
স্বাধীনতার লাল-সবুজের পতাকা বিজয় করেও দেশকে প্রকৃত অর্থেই জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মার্ট সোনার বাংলা রচনায় দক্ষ প্রশাসক হিসেবে আজ মৃত্যুঞ্জয়ী বীর হিসেবেই অনুসরণীয় হয়ে আছেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী। ২০ জুনায়ারি তার ৭৯তম জন্মদিন। কুষ্টিয়া অধিবাসী কৃষিচিন্তক প্রয়াত নূরুল ইসলাম সিদ্দিক এবং রত্নগর্ভা মা বেগম হামিদা সিদ্দিকের কোল আলো করে পৃথিবীতে এসেছিলেন ১৯৪৫ সালে। প্রকৌশলী পেশার জ্ঞান কাজে লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল ভারতের ‘বেতাই’ ইয়্যুথ ক্যাম্প থেকে কুষ্টিয়া-পাবনা অঞ্চল হানাদার মুক্ত করতে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন রণাঙ্গনে। মুক্তিযদ্ধের পর দেশ গড়ার যুদ্ধেও ছিলেন অগ্রগামী। স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি ও অকৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ব্যবস্থা উন্নীতকরণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে দারিদ্র্য বিমোচনে অনুঘটক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
সত্তরের দশকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতায় যে ইঞ্জিনিয়ারিং সেল গঠন করা হয়েছিলো ১৯৮২ সালে সেই পল্লপূর্ত কর্মসূচিকে উন্নয়ন বাজেটের আওতায় ‘ওয়ার্কস প্রোগ্রাম উইং’ এ রুপান্তরের মাধ্যমে ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে ওয়ার্কস প্রোগ্রাম উইং রাজস্ব বাজেটের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল ব্যুরো (এলজিইবি) রূপে পুনর্গঠিত করেন। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালের আগস্ট মাসে এলজিইবিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) হিসেবে উন্নীত করা হয়।
অল্পসময়ের মধেই নানা দূরদর্শী উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রশংসা কুড়িয়েছেন দেশে-বিদেশে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশলে বাজিমাৎ করে বিশ্বব্যাংক থেকে ‘ম্যাজিক বয়’ স্বীকৃতিতে ভূষিত হন এই স্মার্ট প্রশাসক। দেশেও অর্জন করেছেন ডজন খানেক স্বর্ণপদক। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও বিদেশে বসে দেশে পাতাল সড়কের প্রকৌশল নকশা নিয়ে অপর গুণী প্রকৌশলী জামিলুর রেজা-কে মেইল পাঠান। অবশ্য দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননাটা এখনো যুক্ত হয় নি এই প্রবাদ পুরুষের নামের সঙ্গে।
প্রসঙ্গক্রমে এ নিয়ে জীবদ্দশাতে খেদ প্রকাশ করে তিনি জানিয়েছিলেন, কেবল গ্রাম নয়; হাতিরঝিল থেকে পাতাল রেল সব পরিকল্পনাতেই জুড়ে আছে তাঁর নাম। তিনি ছিলেন ভিশনারি টেকনোক্র্যাট।
দীর্ঘদিন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক এর সঙ্গে কাজ করে অবসরে যাওয়া এলজিইডি’র প্রাক্তন প্রধান প্রকৌশলী মোঃ শহিদুল হাসান মনে করেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের পেছনে সরকারি ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বিকার্য। বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতায় তাঁর কাজের প্রতিফলন সুস্পষ্ট। তাই কেবল মৃত্যুর পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গার্ড অব অনার দেয়া ছাড়া গুণী এই কর্মবীরকে জাতীয় সম্মাননা না দেয়া জাতীয় ব্যর্থতা। আমাদের আর বিলম্ব না করে তাঁকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা উচিত।
এই সম্মাননা না পাওয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ফ্লোরিডা ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ডিস্ট্রিক্ট সিনিয়র জিআইস ডেভেলপার সাকির আহমেদ বললেন, উনার সবগুলো উদ্যোগই ছিলো স্মার্ট। আমরা গৎবাঁধা কাজ নয়, ‘এভরি ডে ম্যানেজমেন্ট’ এ ‘প্রায়োরিটি’ বিষয়ে তার কাছ থেকে শিখেছি। দক্ষতা উন্নয়নে কর্মচারীদের বিদেশে প্রশিক্ষণ, কাজের গাইড লাইন, তাৎক্ষণিক কাজের ইনপুট দেয়ায় তিনি ছিলেন কিংবদন্তী। সিদ্দিক স্যারের ভিশনটা আমরা লক্ষ্য করেছি তিনি উন্নয়নের কাথা মাথায় রেখে সব কাজ করেছেন। বর্তমানে এলজিইডিতে তাকে কতটুকু অনুসরণ করতে পারছেন তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। একই সঙ্গে তিন কেন এখনো জাতীয় সম্মাননা পেলেন না সেটাও বুঝি না। সতীর্থদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে প্রথম ২টি আইবিএম মেইনফ্রেম কম্পিউটার পিসি এনে এলজিইডিতে ব্যবহার শুরু করেন তিনি। সেই কম্পিউটার দেশে অনুপ্রাণিত হয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদও রাষ্ট্রীয় কাজে কম্পিউটারের ব্যবহারে আগ্রহী হন। ১৯৮৮ সালে জমির মৌজার হার্ড কপি ম্যাপের ডিজিটাল ম্যাপিং শুরু করেন এই ‘বড় স্যার’। ১৯৯৪ সালে ইন্টারনেট, ই-মেইল এর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবসাইটও তৈরি করান কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। পিডিবি’র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের সময় খুলনা থেকে ডিজিটাল বিলিং সিস্টেম চালু করেন। ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে পরিসংখ্যান ব্যুরোর সঙ্গে জনশুমারিতে প্রকৌশলী জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। ডিএলআরএস সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে যে ম্যাপিং করেছেন তাকে ভিত্তি করেই আজ কাজ করছে প্রতিটি সরকারি অধিদপ্তর। ওই সময়েই এলজিইডিতে গ্লোবাল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) ইউনিট উদ্বোধন করে প্রস্তাবিত ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স পরিকল্পনায় মুগ্ধ হয়ে সেখানে ডিজিটাল সার্ভিস সেন্টার পরিকল্পনায় যুক্ত করেন প্রকৌশলী সজীব ওয়াজেদ জয়-কে।
এছাড়াও আজ থেকে ২৫ বছর আগে ১৯৯৯ সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগের জন্য জিআইএস ব্যবহার কাস্টম ম্যাপিং সফটওয়্যার তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় পিডিবি পেয়েছিল নতুন আলোর সন্ধান, তাঁর যুগোপযোগী কর্মকাণ্ডে পূর্ত মন্ত্রণালয় জেগে উঠেছিল নতুন স্বপ্নের আবির নিয়ে; সবশেষে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের কর্মকাণ্ড নিয়েও নতুনভাবে চিন্তার সূত্রপাত করেছিলেন৷ এভাবেই সরকারি কর্মকর্তাদের চিরায়ত ট্যাবু ভেঙ্গে নিজে কাজ করে অন্যদের কাজ শেখানো এবং প্রশিক্ষণ ও উদ্ভাবনে আমৃত্যু সহকর্মীদের অনুপ্রাণিত করেছেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের- মানুষ নির্মাণ করে প্রয়োজনে, সৃষ্টি করে আনন্দে, বুদ্ধির পরিচয় দেয় জ্ঞানে, যোগ্যতার পরিচয় দেয় কৃতিত্বে, নিজের পরিচয় দেয় সৃষ্টিতে৷ কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ছিলেন এই মর্মবাণীর প্রতিবিম্ব৷ ২০০৮ সালেল ১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে একমাত্র ছেলে সাইফুল ইসলাম সিদ্দিক এর বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই প্রজ্বল নক্ষত্র সদৃশ উন্নয়ন ব্যাক্তিত্ব।
ইমদাদুল হক: নির্বাহী সম্পাদক, ডিজিবাংলাটেক.নিউজ