জাহাঙ্গীর আলম শোভন
বাংলাদেশের লজিস্টিকস ও সাপ্লাই চেইন মূলত প্রচলিত ব্যবস্থার উপর গড়ে উঠেছে। আমাদের ঐতিহ্যবাহী নদী ও নৌচলাচল ছিল এদেশের রসদ ব্যবস্থার প্রাণ তথা মূল শেকল। তারসাথে যুক্ত ছিল স্থানীয় পরিবহন নৌকা ও গরুর গাড়ি পরবর্তীতে আধুনিক পরিবহন। সাথে শ্রমজীবি মানুষদের সেবাও রয়েছে। দূর-দূরান্তে ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক পণ্য মানুষের মাধ্যমে বহনের ব্যবহার এখনো উঠে যায়নি। বিশেষ করে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে মানবচালিত রিকশাবাহন দ্বারা পরিশীলিত হয়েছে। রিকসা সাইকেল এসব পরিবহন এখনো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রধান বাহন। ডিজিটাল সেবা উন্নতির পরও বিশ্বব্যাপী বাইকের পাশাপাশি বাই সাইকেলও টিকে রয়েছে ।
লজিস্টিকস বা রসদ সরবরাহ যেমন আমাদের জীবন যাত্রার অংশ তেমনি এটা বিশাল এক ব্যবসা খাত যাকে আমরা ইন্ডাস্ট্রি বলতে পছন্দ করছি। এই শিল্প দিন দিন সকল অর্থেই বিস্তৃত ও বিকশিত হয়ে চলেছে। লজিস্টিকস এর উপখাতগুলোকে সাধারণ মানুষ আসলে সেবা হিসেবে পাই। প্রোডাক্টস বা পণ্য হিসেবে ভোক্তার দিক থেকে চাহিদা হলো সেরা সেবাটি সহজে এবং যৌক্তিক দামে ভোগ করার সুযোগ পাওয়া।
যিনি সেবা প্রদান করেন তিনি যখন সেবার মান উন্নয়ন করার জন্য এবং সেবাকে নজরদারীর মধ্যে রাখতে চান তখনি তার কয়েকটি বিষয় প্রয়োজন হয়। প্রথমত একটি পরিকল্পনা, দ্বিতীয়ত চাহিদা পূরণ ও সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে তৈরী করা, তৃতীয়ত: সেবার উন্নয়নের জন্য উপাদান, হাতিয়ার ও প্রযুক্তির ব্যবহার করা, এবং চতুর্থত: পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার জন্য দক্ষ বা উপযুক্ত জনকাঠামো গড়ে তোলা।
ঠিক এই কাজটি করতে গিয়ে আসে নানা প্রযুক্তির ব্যবহার ও তার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান, সেবার উন্নয়ন কিংবা সার্বিকভাবে বৈশ্বিক মানের সাথে নিজেদের এক কাতারে দাড় করানো। তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের যে স্রোত তা আমরা ধরতে পারিনি একদিকে আমাদের প্রস্তুতি ও দূরদর্শিতা ছিলনা অন্যদিকে যুদ্ধ বিধস্থ দেশ হিসেবে তখন টিকে থাকাটাই চ্যালেঞ্জ ছিল।
এখন আমরা প্রস্তুত রয়েছি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ডাকে সাড়া দিতে। এজন্য আমাদের লজিস্টিক খাতে আধুনিক মেশিনারী ব্যবহার নিশ্চিত করে তা দিয়ে পণ্য সেবার মান উন্নত করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে আধুনিক পরিবহন থেকে শুরু করে প্যাকেজিং পর্যন্ত এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ভোক্তার আরো নিকটে আরো সহজে আরো দ্রতসময়ে আরো কম খরচে সেবাকে পৌঁছে দিতে পারা। এটাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মূল কাজ। এর সাথে আধুনিক ফোরআইআর প্রযুক্তির ব্যবহার দ্বারা পুরো সেবাকে টেকসই ও বিশ্বমানের করে তোলা। রোবোটিক্স, বিগডেটা, আওটি, অগমেন্টেড রিয়েলিটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লক চেইন এসবের ব্যবহার নিশ্চিত করা। সেবার মান যেমন আন্তরিকতা ও দক্ষতা দিয়ে বাড়াতে হয় তেমনি প্রযুক্তি দিয়ে বাড়াতে হয়। কারণ প্রযুক্তির সমন্বয় না করলে গ্লোবাল লজিস্টিক এর সাথে সমন্বয় করে সেবা নিশ্চিত সম্ভব হবে না।
কোনো ধরনের লজিস্টিক পলিসি ছাড়াই মূলত শিল্পনীতির কিছু নির্দেশনা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ঠ আইন ও বিধি অনুসারে এই খাতের সেবা বিকশিত হয়ে আসছিল। কোনো নীতিমালা না থাকা কোনো ঘাটতি নির্দেশ করে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা এক ধরনের সক্ষমতা নির্দেশ করে বিশেষ করে যদি নির্দিষ্ঠ নীতিমালা ব্যতিত সংশ্লিষ্ঠ বিধি দ্বারা খাতের বিকাশ হয়। তাছাড়া দেশে প্রচলিত অনেক আইন ও বিধি রয়েছে যেগুলো বিভিন্নক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য। তবে সময়োপোযোগী কিছু করনীয় ঠিক করা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য নীতিমালা বা পলিসির প্রয়োজন আছে বৈকি? যেহেতু নানা পলিসি ও বিধি থাকা সত্বেও এলডিসি গ্রাজুয়েশন, এসডিজি লোকালাইজেশন ও ফোর আইআর এর কথা মাথায় রেখে নতুন রসদ নীতিমালা বা লজিস্টিক পলিসি তৈরী হচ্ছে। তার নাম হওয়া প্রয়োজন স্মার্ট লজিস্টিক পলিসি।
সরকার জাতীয় রসদ নীতিমালা বা লজিস্টিক পলিসির কাজে হাত দিয়েছে। একদিকে এটা জিরোড্রাপ্ট দিয়ে শুরু করতে হচ্ছে অন্যদিকে সরকারী বেসরকারী শতাধিক অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে এই নীতি তৈরীর কাজ চলছে। সকল খাতকে সমন্বয়ের সুবিধার্থে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কাজটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। প্রথম এবং দ্বিতীয় কাজটি করা হয়ে গিয়েছে। লজিস্টিক বা রসদ খাতের ২১টি উপখাত চিহ্নিত করা হয়েছে। উপখাতের উপখাতগুলো অংশীজনদের পরামর্শের মধ্যে অন্তভূক্ত হবে এছাড়া সম্পৃক্ত এজেন্সি ও ব্যবসাখাতকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এখন কাজ হলো নীতি ও করনীয় (পলিসি এন্ড একশন প্লান) চূড়ান্ত করা। এর মধ্যে কোনো ধরনের ঘাটতি বা মিসিং লিংক যেন না হয় সেটা খেয়াল করা। এই নীতি-পলিসি যেভাবে তৈরী হোক সেটা পরে সংশোধনযোগ্য বটে।
কিন্তু মূল চ্যালেঞ্জ হলো ভারসাম্যপূর্ণভাবে তা বাস্তবায়ন করা। আমাদের দেশে এখনো ভারসাম্য রেখে কোনো পলিসি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কারণ সরকারী দপ্তরগুলোর দক্ষতা, মানসিকতা, নেতৃত্ব ও চর্চা একরকম নয়। স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক বরাদ্ধ সত্বেও কোনো উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ আমাদের সরকারের মেগাপ্রকল্পে যে বাজেট ব্যয় হয় স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় তারচেয়ে কম নয়। এখানে শুধু প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও দূর্নীতিমূক্ত রাখা। শিক্ষার ব্যাপারে একই কথা খাটে। এখানে যদিও পরিবর্তনের একটি রেখাপাত শুরু হয়েছে। আদালতে ১৬ লক্ষ মামলার জট লেগে আছে দেশ ডিজিটাল হয়ে গেছে অথচ আমরা এই জট থেকে বের হতে পারিনি। তাই ডিজিটাল প্রযুক্তি তার সর্বত্র সমান্তরাল ব্যবহার, বৈষম্যহীন উপকারভোগিতা ও সময়ের সাথে প্রযুক্তির সমন্বয় সম্ভব স্মার্ট লজিস্টিক পলিসি এর মাধ্যমে। এজন্য আমার প্রথম প্রস্তাব হবে এই পলিসি শুধু লজিস্টিক পলিসি না করে স্মার্ট লজিস্টিক পলিসি হিসেবে তৈরী করা। তাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কাফেলায় যোগ দিতে হলে স্মার্ট লজিস্টিক নীতিমালা দরকার।
সরকারী প্রতিষ্ঠানের গতির ভারসাম্যহীনতার একটা উদাহরণ হলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তথা ট্রেড লাইসেন্স আইন। এই আইনটি ২০১৬ সালে নতুন করে প্রণয়ণ করা হলেও তখনকার সময়ে দেশে প্রচলিত নতুন ও আওটি ভিত্তিক অসংখ্য ব্যবসা এর মধ্যে অন্তভূন্ত হয়নি। ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত চার বছরে প্রাইভেট সেক্টর থেকে নতুন ধরনের প্রায় ৩শটি ব্যবসা ট্রেড লাইসেন্স ক্যাটাগরিতে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে কিন্তু বাস্তবাতা হলেও দফায় দফায় চিঠিও সভা করে আইনটিকে সংশোধনের জন্য তৈরী করা যায়নি। শুধু নতুন শাখা নয় এখানে নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ সুবিধা দরকার, আবাসিক উদ্যোক্তাদের জন্য শর্ত শিথিল করা দরকার। সেটা না করে উল্টো ১০% জরিমানা ধার্য করা হয়েছে। একটি মাত্র নতুনত্ব সার্কুলার হয়েছে যা ইতিবাচক তা হলো ৫ বছরের জন্য একসাথে লাইসেন্স নবায়ন করা যায়। কিন্তু আরো প্রয়োজনীয় চাওয়াগুলো আসেনি। ই-কমার্স এর মতো জনপ্রিয় ব্যবসা ট্রেড লাইসেন্স আইনে নেই। এ খাতের উদ্যোক্তারা তাদের ট্রেড লাইসেন্স এ অন্য কিছু লিখে ব্যবসার বৈধতা নিয়ে থাকেন।
ই-কমার্সের মাধ্যমে ব্যক্তি পর্যায়ে আন্তজাতিক ক্রয় বিক্রয়ে নানারকম প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। আমাদের দেশের বাইরে থাকা যে পরিমাণ প্রবাসী অনেক দেশের নাগরিক সংখ্যাও তার সমান নয়। এছাড়া আমাদের ক্ষুদ্র শিল্প থেকে শুরু করে এমন অনেক কিছুই রয়েছে যা আমরা বৈশ্বিক ক্রেতার উপযোগী করে সেবা দিতে পারি। এখানেও নানাবিধ সংকট আছে। একক একটি পণ্য রপ্তানী কিংবা আমদানীর জন্য এক জাহাজ ভর্তি পণ্যের নিয়ম অনুসরণ করা যুক্তিযুক্ত নয়। আমাদের পণ্যের দাম যদি হয় ২ হাজার টাকা আর তা প্রেরণের খরচ ৩ হাজার টাকা। হয়তো একজন ক্রেতার ৫ হাজার টাকা দিয়ে দেশের বাইরে থেকে দেশের একটা পণ্য কেনার সামর্থ্য আছে। কিন্তু ২ হাজার টাকা পণ্যে ৩ হাজার টাকা শিপিং বা কুরিয়ার চার্জ ক্রেতাকে পণ্যটি ক্রয় করতে নিরুৎসাহিত হয়।তার মনে হয় তিনি একটা পণ্য প্রায় দ্বিগুনের বেশী দাম দিয়ে কিনছেন। তখনি তার পণ্যটি কেনার চিন্তা উবে যায়। তার উপর রয়েছে পেমেন্ট সমস্যা।
বাংলাদেশের বাইরে থাকা একজন ক্রেতার দুনিয়ার অন্য কোথা থেকে অনলাইনে পণ্য কিনতে যদি কার্ডের তথ্যের পাশাপাশি ব্যক্তিগত তথ্য কিংবা পাসপোর্ট দেখাতে হয় তাহলে কেন তিনি বাংলাদেশী ই-কমার্স ওয়েবসাইট থেকে পণ্য কিনবেন বা অর্ডার করবেন। তারউপর এখান থেকে পণ্য কিনলে তিনি সে পণ্য পছন্দ না হলে ফেরত পাঠাতে পারবেন না আবার তার পেমেন্টও ফেরত নিতে পারবেন না অথবা এসব করার জন্য তাকে জটিল প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।একটি ব্যবসায়িক লেনদেন এর জন্য যদি সাধারণ কাজে এমন সমস্যা থাকে ক্রেতা হিসেবে তার পছন্দের তালিকায় বাংলাদেশ থাকবেনা। তাই লজিস্টিক পলিসিতে এখনি বিষয়গুলো অন্তভূক্ত করে একে জরুরী একশন প্লান এর মধ্যে এনে সমাধান করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে একই রেখায় থাকা দুটি চাকার মধ্যে একটি চাকা ছোট হলে যেমন সে গাড়ি ঘুরে ঘুরে আগের জায়গায় ফিরে আসে। তেমনি আমাদের একটি দপ্তর এগিয়ে যাবে আর অন্য দপ্তর শম্ভুক গতি নিয়ে কাজ করবে তাহলে স্মার্ট বাংলাদেশের বাস্তবায়ন আংশিক বা খন্ডিত আকারে হবে এবং সেখান থেকে জনগণ বেশী সুফল হবেনা। এসব বিষয় মাথায় রেখেই আমাদের পলিসি তৈরী করা সময়ের দাবী।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন।
দ্রষ্টব্য: অভিমত-এ প্রকাশিত পুরো মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ডিজিটাল বাংলা মিডিয়া কর্তৃপক্ষের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বহুমতের প্রতিফলন গণমাধ্যমের অন্যতম সূচক হিসেবে নীতিগত কোনো সম্পাদনা ছাড়েই এই লেখা প্রকাশ করা হয়। এতে কেই সংক্ষুবদ্ধ বা উদ্বেলিত হলে তা তার একান্ত বিষয়।