ভাষার পাশাপাশি ‘বর্ণ’ এর প্রতি ভালোবাসার আহ্বান জানিয়ে জনগোষ্ঠির সকলকে সম্পৃক্ত করে ইন্টারনেটে বাংলা ভাষার করপাস উন্নয়নে পরামর্শ দিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এজন্য মানসম্মত বাংলা কন্টেন্ট বাড়ানো এবং এটি তৈরিতে মেধাসত্বকে গুরুত্ব দিতে বলেছেন তিনি। বলেছেন, রোমান হরফে নয়, বাংলা লেখা উচিত বাংলা প্রেমেই। আর বর্ণ বৈচিত্রের কারণেই বাংলা ভাষার মতো সমৃদ্ধ ভাষা আর একটি নেই। ইন্টারনেটের বাংলা ভাষার উন্নয় সবাই এগিয়ে এলে আমরা পিছিয়ে থাকবো না।
মোবাইলফোন অপারেটরদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, আগামীকাল আমরা বাংলায় এসএমএস সেবা চালু করছি। তবে আমি এখন রবি’র মতো অপারেটরদের এখন উচিত প্রান্তিক মানুষের কাছে আঞ্চলিক ভাষায় বার্তা পৌঁছে দেয়া। এটা করতে পারলে ব্যবসা বাড়বে।
শনিবার গুলশানে রবি’র প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘প্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার’ বিষয়ে নিয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, “সরকারের গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্প-এর আওতায় ইতোমধ্যে মোট ১৬টি টুলস উন্নয়ন করা হচ্ছে। তবে এটা সরকারের একার কাজ নয়। করপাস উন্নয়নে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। ”
বিশ্বে বাংলাদেশই বাংলাভাষার নেতৃত্ব দেবে উল্লেখ করে মন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করে মন্ত্রী বলেন, ভাষা নদীর মতো বহমান। ভাষার কিছু অপব্যবহার সত্ত্বেও প্রবাহমান নদীর মতো বাংলা আপন গতিতে প্রবাহমান থাকবে। এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আমাদের কাজ তরুণ প্রজন্মকে সংশ্লিষ্ট করে প্রযুক্তির মাধ্যমে এর অগ্রগতি নিশ্চিত করা। সবাই এখনো বাংলা ভাষা বিশ্বে সপ্তম বললেও প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার বিকাশের মাধ্যমে আমার হিসাবে বাংলা ভাষা মূলত বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “শুধু ভাষাকে নয়, আমাদের বর্ণমালাটিকেও ভালবাসতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশই বাংলার রাজধানী। বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদেরই কাজ করতে হবে।” সে প্রেক্ষিতে অনন্য এই উদ্যোগ নেয়ার জন্য রবিকে ধন্যবাদ জানান মোস্তাফা জব্বার।
রবি’র হেড অব কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স শাহেদ আলমের সঞ্চালনায় সভায় আরো বক্তব্য রাখেন বিটিআরসি মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল নাসিম পারভেজ, বিজয় ডিজিটাল সিইও জুঁই, টেলিকম রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের সভাপতি রাশেদ মেহেদী ও টেকশহর সম্পাদক মোহাম্মদ খান।
বক্তব্যে বাংলা করপাস সমৃদ্ধ না হওয়া এবং ৫ বছরের প্রযুক্তিতে বাংলা প্রকল্পের অগ্রগতি না হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন টিআরএনবি সভাপতি ও দৈনিক সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি রাশেদ মেহেদী। এছড়াও দূতাবাসগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে প্রবাসীরা যেন দেশগুলোতে বাংলা ফরম ব্যবস্থা চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করেন মোহাম্মাদ খান।
বক্তব্যে বিজয় ডিজিটাল-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন জুঁই বলেন, “শিশুকে আমরা প্রথম কিন্তু ‘এ’ শিখাই না; শিখাই ‘অ’। এটা উপলব্ধির ব্যপার। তাই প্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহারকে আরো তরাম্বিত করতে আমাদের সেই উপলদ্ধির জায়গাটা থেকে কাজ করতে হবে। বিজয় ডিজিটালের আওতায় আমরা শিশুতোষ উপায়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে শিশুদের কাছে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত তাদের পাঠ্যপুস্তকের পাঠগুলো উপস্থাপন করছি। সেই উপস্থাপন বাংলায় বলেই আমরা তাদের কাছাকাছি পৌঁছুতে পারছি। ”
রাশেদ মেহেদী বলেন, “ইন্টারনেটে আমাদের বাংলার পরিভাষাভিত্তিক শব্দভাণ্ডার নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তি-নির্ভর সাহিত্যও প্রযুক্তিতে ওই ভাষার ব্যবহারকে সমৃদ্ধ করতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণের জন্য সরকার ১৬টি টুলস উন্নয়নের যে উদ্যোগ নিয়েছে তার বাস্তবায়ন আরো তরাম্বিত করা না গেলে আমরা পিছিয়ে যাবো। এক্ষেত্রে সরকার একা না পারলে রবি’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তথা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এর সঙ্গে সংযুক্ত করা পারে।”
মুহাম্মদ খান বলেন, “প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার উপস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্টির মাত্রাটা ৫০ শতাংশ এর বেশি না। এক্ষেত্রে অগ্রগতির জন্য আরো সরকারী উদ্যোগ কাম্য। পাশাপাশি প্রবাসীরা যেন সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সাথে বাংলায় যোগাযোগ বলতে পারেন সে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অন্যান্য ভাষার ক্ষেত্রে সে উদাহরণ রয়েছে।”
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রবি’র ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিয়াজ রশিদ। সমাপনী বক্তব্যে তিনি বলেন, “প্রযুক্তিতে বাংলাকে এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যেন মানুষ তা সহজে বুঝতে ও ব্যবহার করতে পারেন।”
এছাড়াও শ্রোতাদের সারি থেকে সভায় অংশ নিয়ে রবি আজিয়াটা লিমিটেড’র চিফ কমার্শিয়াল অফিসার শিহাব আহমদ বলেন, “প্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহারকে সর্বজনীন করতে তিনটি ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, বিনোদন নির্ভরতা থেকে সরে এসে প্রায়োগিক দিকটিতে মনোযোগ দিতে হবে। মানুষ যেন তার নিত্যদিনের প্রয়োজন বাংলা ভাষায় প্রযুক্তির মাধ্যমে সারতে পারেন। দ্বিতীয়ত, সবার হাতে ডিভাইস পৌঁছে দিতে তা আরো সাশ্রয়ী হতে হবে। বাংলাদেশে হ্যান্ডসেট উৎপাদিত হলেও দাম কিন্তু এখনো সবার নাগালে আসেনি। এ ব্যপারে অন্য কী কী উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে সে ব্যপারে সংশিষ্ট সবাইকে ভাবতে হবে। তৃতীয়ত, বাংলা ভাষায় সার্চ দিয়ে কনটেন্টের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।”
এর আগে বিটিআরসি মহাপরিচালক নাসিম পারভেজ বাংলাভাষার অর্থনৈতিক গুরুত্বারোপ করেন এবং বিটিআরসি’র নেয়া নানা উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিটিআরসি-এর সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস ডিভিশন-এর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ বলেন, “প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার অন্তর্ভূক্তির ফলেই আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে পেরেছি। জনসংখ্যার বিচারে বাংলা সপ্তম অবস্থানে থাকলেও ইন্টারনেট ব্যবহারে শীর্ষ ৪০টি ভাষার মধ্যে বাংলা ঠাঁই পায়নি। তাই বাংলার মাধ্যমে প্রযুক্তিকে সর্বস্তরের জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে।”
তিনি বলেন, “মোবাইল আর্থিক সেবা বাংলায় সহজলভ্য হওয়ার কারণেই কিন্তু দেশের আর্থিক অগ্রগতি ত্বরাম্বিত হচ্ছে। প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার যত বাড়বে, ডিজিটাল বিভক্তি তত দূর হবে; তাহলে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে দেশ।”
রবি’র চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, “জাতীয় কল সেন্টার ৩৩৩ শুরু হয়েছিল রবি’র অর্থায়নে এবং কারিগরি সহায়তায়। জাতীয় তথ্য বাতায়ন নির্মাণে যুক্ত ছিলেন রবি’র তথ্য-প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ। রবি-টেন মিনিট স্কুল ইতোমধ্যে সফলতা লাভ করেছে। হাতে কলমে বাংলায় কারিগরি শিক্ষা দেয়ার জন্য শিগরিরই আমরা আরো একটি প্রকল্প হাতে নেব। প্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহারকে সহজলভ্য করতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যহত থাকবে। ”