দেশী আমের আটিঁর বীজের নির্যাস থেকে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান মানবদেহ ও পশু-পাখির বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াকে কুপোকাত করতে সক্ষম। পরিত্যক্ত আমের বীজ বা আটিঁর গুণাগুণ নিয়ে ল্যাব গবেষণায় প্রাথমিক সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণের এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যলয়টির মাইক্রোবায়োজলি এন্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন।
নিজস্ব অর্থায়নে ২০২৩ সালের এপ্রিলে গবেষণাটি শুরু করেন গবেষক দলটি। এই দলের অপর সদস্যরা হলেন- বাকিৃবি’র মাইক্রোবায়োলজি এন্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. সুকুমার সাহা, ফিজিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শারমিন আক্তার, কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. বিপ্লব কুমার সাহা, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী রাহীলা জান্নাত সাদিয়া, চন্দন সিকদার, আনন্দ মজুমদার, মোসলেমা জাহান মৌ এবং নাজমুল হাসান সিয়াম।
গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল একটি বৈজ্ঞানিক জার্নালে গৃহীত হয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষণাদলের প্রধান। তবে গবেষণার প্রতিবেদনের অ্যাবসট্রাক্ট প্রকাশ করলেও ফিস জটিলতায় পুরো গবেষণা প্রতিবেদনটি এখনো প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। এই প্রতিবেদনটি প্রকাশে ১৫০০ ডালারের মতো পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন বাকৃবি’র মাইক্রোবায়োজলি এন্ড হাইজিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. কেএমএইচ নাজির হুসাইন নাজির। ডিজিবাংলা’র সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, গবেষণাটি ইউনিক ফলে লন্ডন থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত বিএমসি জার্নাল আমাদের গবেষণা প্রতিবেদনটি হাতে পেয়ে এর অ্যাবাস্ট্রাক্ট প্রকাশ করেছে। কিন্তু জার্নালে পুরো গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি এখনো। কারণ এজন্য ১৫০০ ডলারের মতো ফিস দিতে হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমরা এই গবেষণা করে আরো এতোগুলো অর্থ খরচের অবস্থায় নেই। তবে চেষ্টা করছি।
গবেষণায় স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে পর্যবেক্ষণ করে গবেষকদল দেখেছেন, আমের বীজের নির্যাস ব্যাকটেরিয়ার কোষের গঠন ধ্বংস করতে সক্ষম। এটি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা তৈরি বায়োফিল্মও ধ্বংস করতে পারে। ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত ইঁদুরের ওপর এই নির্যাস প্রয়োগে ওই সংক্রমিত ইঁদুরগুলো দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।
এ বিষয়ে গবেষক ড. গোলজার হোসেন বলেন, ‘আমরা রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করে আমের পরিত্যক্ত বীজ থেকে একটি নির্যাস তৈরি করি, যা কিছু ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ইঁদুরে সেই নির্যাস পরীক্ষার সময় দেখা গেছে যে, এই নির্যাসের বিষাক্ততা নেই বললেই চলে এবং উচ্চ মাত্রায় এই নির্যাস প্রয়োগে ইঁদুরগুলোর লিভার ও কিডনিতে সামান্য পরিবর্তন দেখা গেলেও, উল্লেখযোগ্য কোনো খারাপ লক্ষণ দেখা যায়নি।’
আমের আটিঁর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান প্রয়োগের ভবিষ্যত সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমরা পোল্ট্রিতে এই নির্যাস প্রয়োগের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছি। যদি সফল হই, এটি বাংলাদেশের পোল্ট্রি সেক্টর ও স্বাস্থ্যখাতে দৃশ্যমান অবদান রাখবে এবং অর্থনৈতিক সাশ্রয় সাধিত হবে, যা জাতীয় উন্নয়নে সহায়ক হবে।’
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স নিয়ে প্রধান গবেষক ড. গোলজার জানান, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) সারাবিশ্বে একটি বৈশ্বিক হুমকি। মানুষের পাশাপাশি প্রাণীর ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকই প্রধান ভরসা। তবে, অনেক ব্যাকটেরিয়া বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত সিন্থেটিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্টের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এএমআরকে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ভেষজ ঔষধগুলো সিন্থেটিক ওষুধের বিকল্প হিসেবে নিরাপদ, সুবিধাজনক এবং সাশ্রয়ী। ডব্লিউএইচও ভেষজ পরিত্যক্ত পদার্থ নিয়ে গবেষণার উপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে অন্যতম। আমে বিভিন্ন ধরনের ম্যাক্রো ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট থাকে। আমের খোসা ও বীজের কার্নেল ঔষধি গুণাগুণসম্পন্ন হলেও সাধারণত এই অংশগুলো পরিত্যক্ত হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়। ইতোপূর্বে আমের খোসা ও পাতার অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল কার্যকারিতা নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে, তবে আমের বীজের (আটিঁ) কার্যকারিতা নিয়ে বাংলাদেশে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা পাওয়া যায়নি। যদিও কয়েকটি দেশে এ বিষয় নিয়ে প্রাথমিক গবেষণা হয়েছে।
গবেষণার বিষয়ে অধ্যাপক ড. সুকুমার সাহা বলেন, ‘যেসব ব্যাকটেরিয়া গ্রাম নেগেটিভ সেসব ব্যাকটেরিয়ার উপর এর কার্যকরীতা তেমন নেই। এর অর্থ এই ক্রুড নির্যাসটির এর মধ্যে এমন কোনো কিছু আছে যা কিনা এই ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করেছে। এখন আমাদের অধ্যাপক গোলজারের টিমের যেটি মেইন কাজ, তারা এই সক্রিয় উপাদানটি বের করার চেষ্টা করবে। যে সক্রিয় উপাদানটি ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করেছে, সেটি যদি বের করা যায়, তবে আমি বলতে পারি যে বর্তমানে এটির যে বিষাক্ততা আছে সেটির ৯৯.৯৯ ভাগ চলে যাবে।’