দেশে অনলাইন জুয়ার ব্যাপক বিস্তারে মূলধারার সম্প্রচার মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার, অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অর্থপাচার এবং জুয়ার ব্যাপক প্রসারের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সংস্থাটি বলছে, সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অনলাইন জুয়া বন্ধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। উল্টো ভিন্ন মোড়কে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে, স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
বৃহস্পতিবার (৯ মে) সংবাদমাধ্যমে পাঠানো সংস্থার আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবি’র এ উদ্বেগের কথা জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বিজনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকে, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে অনলাইন জুয়ার নেশার কবল থেকে রক্ষা করতে অবিলম্বে এ সংক্রান্ত সব ধরনের বিজ্ঞাপন বন্ধ ও জুয়া প্রতিরোধে আইন প্রণয়নসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বপ্রণোদিত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানায় টিআইবি।
উদ্বেগ প্রকাশ করে টিআইবি জানায়, দেশের প্রচলিত আইনে যে কোনো ধরনের জুয়া নিষিদ্ধ হলেও নানা কৌশলে অনলাইন জুয়ার প্রচার ও প্রসার চলছেই। মূলধারার সম্প্রচার মাধ্যমে আইপিএল, বিপিএলসহ বিভিন্ন জনপ্রিয় খেলা সম্প্রচারসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বেটিং সাইটের চটকদার বিজ্ঞাপন ভিন্ন মোড়কে বা ‘সারোগেট’ বিজ্ঞাপন আকারে প্রচার করা হচ্ছে। এমন কী এ বছরের বিপিএল-এর একটি দলের জার্সিতে জুয়ার ওয়েবসাইটের সারোগেট বিজ্ঞাপনও দেখা যায়।
এ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, চরম উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি, দেশে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের মহোৎসব চলছে। আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শুধু মুনাফার লোভে দেশকে চরম বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া কোনোমতেই দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে না। ইদানিং শহরের বিভিন্ন বিলবোর্ডেও অনলাইন জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতে দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, গত বছর উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশন; বিশেষ করে স্পোর্টস চ্যানেলসহ ডিজিটাল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বাজি ও জুয়ার বিজ্ঞাপনের রমরমা প্রচার চলছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এ ধরনের বিজ্ঞাপনের কুফল উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, টিআইবি মনে করে, শুধুমাত্র অনলাইন জুয়ার মাধ্যমেই দেশ থেকে বিপুল অংকের টাকাও পাচার হয়ে যাচ্ছে, যা আরো বড় উদ্বেগের বিষয়! গণমাধ্যম ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের সূত্রে জানা যায়, শহর থেকে গ্রামসহ সারাদেশে লাখ লাখ মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজ অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন।
এর মাধ্যমে বিপুল অংকের টাকা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ই-ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড, ক্রিপ্টোকারেন্সিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পাচার হয়। অনলাইন জুয়ার অ্যাপসের বেশির ভাগই রাশিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে পরিচালনা করা হলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এগুলোর স্থানীয় এজেন্ট রয়েছেন।
এসব এজেন্টরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে টাকা আদান-প্রদান করেন। আবার এই এজেন্টদের মাধ্যমেই বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। অথচ চোখের সামনে হয়ে যাওয়া এই পাচার রোধে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-সহ কোনো দায়িত্বশীল সংস্থারই কোনো কৌশলগত উদ্যোগ বা প্রচেষ্টার কথা জানা যায় না।
একইভাবে সব নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনে চলছে এ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনের বিশাল ব্যবসা, যা অবৈধ ও অনৈতিক!
অনলাইন জুয়ার ফলে সামাজিক নানা সংকটেরও জন্ম হচ্ছে উল্লেখ করে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, বিভিন্ন সময়ে জুয়ায় আসক্ত হওয়া ও সর্বস্ব খুইয়ে আত্মহত্যার ঘটনা আমরা নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন সংবাদে দেখছি। সম্প্রতি, ঠাকুরগাঁওয়ে একজন ৩৫ বছরের যুবক অনলাইন জুয়ায় ১৫-২০ লাখ টাকা হারিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। পারিবারিক অশান্তি, কলহ, বিষণ্ণতা, সর্বোপরি জুয়ায় সর্বস্ব খোয়ানোর ঘটনার পাশাপাশি অবৈধ উপায়ে বিপুল বিত্ত-বৈভব অর্জনের ঘটনাও ঘটে চলেছে।
তিনি বলেন, জুয়ার নেশা আমাদের অমিত সম্ভাবনাময় তারুণ্যের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিপন্ন করে তুলছে।
অনলাইন জুয়া প্রতিরোধে বহুমুখী উদ্যোগ প্রয়োজন উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদ ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী, যে কোনো ধরনের জুয়া প্রতিরোধ করতে সরকারের ওপর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে দেশে এখনো জুয়া প্রতিরোধে ব্যবহার হচ্ছে ১শ ৫৭ বছরের পুরনো আইন।
সরকার ‘জুয়া প্রতিরোধ আইন-২০২৩’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও এখনো তা খসড়া পর্যায়েই রয়ে গেছে। অথচ বর্তমান প্রেক্ষাপটে জুয়া প্রতিরোধে কঠোর ও যুগোপযোগী আইন আরো আগেই প্রণীত ও প্রয়োগ হওয়া প্রয়োজন ছিল।
সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, আইনটি এখনো খসড়া অবস্থাতেই রয়েছে। খসড়া আইনের ৬ ধারায় দূরবর্তী জুয়া ও অনলাইন জুয়ার প্রকৃতি এবং ৭ ধারায় বাজি বা বেটিং সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে বেটিং, অনলাইন জুয়া প্রচারণার বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় উপায় সারোগেট বিজ্ঞাপন প্রচার এবং অনলাইন বেটিংয়ের সঙ্গে অর্থ পাচারের যোগসূত্রের ব্যাপারগুলো উপেক্ষা করা হয়েছে।
আবার, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার ৪.৫.৩ (ঘ) ধারা অনুযায়ী, বাজি ধরা বা জুয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত সংস্থা/কোম্পানি/ব্যক্তির বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ করা হলেও সারোগেট বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধে কোনো নির্দেশনা দেওয়া নেই।
অন্যদিকে, অনলাইন জুয়া রোধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বপ্রণোদিত ভূমিকা দেখা যায় না। অনলাইনের অবারিত দুনিয়ায় জুয়া বা বেটিংয়ের প্রসার রোধে সবার আগে এর প্রচারণা রোধ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বপ্রণোদিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
এমতাবস্থায়, তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ, বিএফআইইউ, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, নাগরিক অধিকার সংগঠনসহ সব অংশীজনের সঙ্গে পর্যালোচনার মাধ্যমে খসড়াটি অতি দ্রুত সংশোধন করে আইন প্রণয়ন ও অবিলম্বে প্রয়োগের জোর দাবি জানাচ্ছে টিআইবি।
পাশাপাশি, অনলাইন জুয়া প্রতিরোধে এ সংক্রান্ত সব ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচারের সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত নজরদারি ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানায় টিআইবি।