দেশে প্রথমবারের মতো উপজেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ক্যারিয়ার সম্মেলন। নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার গোল-ই আফরোজ সরকারি অনার্স কলেজ মাঠে চলছে দুই দিনের আইসিটি ফ্রিল্যান্সিং ক্যাম্প ও চাকুরি উৎসব ২০২৩। উৎসবে অংশ নিয়েছে নিবন্ধিত সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থী। চাকরির অফার নিয়ে মেলায় অংশ নিয়েছে ১৫টি আইটি প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও তরুণদের ফিল্যান্সিংয়ের বিষয়ে হাতে-কলমে কর্মশালা নিচ্ছে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার্স ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, কোডার্স ট্রাস্ট, নকরেক আইটি ও জয়ী। সফলতার কৌশলগুলো শেয়ার করছেন সফল ফ্রিল্যান্সাররা। কোথায় ও কীভাবে ফ্রিল্যান্সিং করতে হবে সে বিষয়ে বিশেষ সেশন নিচ্ছে আপওয়ার্ক এর বাংলাদেশী প্রতিনিধিরা। আয়োজনের মধ্যে রয়েছে মোবাইল অ্যাপ উন্নয়ন বিষয়ক কর্মশালা।
শুক্রবার সকালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারসহ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং না ফেরার দেশে পাড়ি জমানো দেশের সকল কৃতী সন্তানদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ক্যাম্পের আনুষ্ঠানিকতা। এরপর আধুনিক সাংস্কৃতিক একাডেমির পক্ষে উপস্থাপন করা হয় ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপান্তর নিয়ে কথক নৃত্য। পরিবেশন করেন চঞ্চল মাহমুদ ও তার দল।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোঃ হুমায়ুন কবির। তার বক্তব্যের পরই এই প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দুই ফ্রিল্যান্সার আশিকুন ইসলাম ও সৌরভ চৌধুরী তাদের সফলতার গল্প শেয়ার করেন। তাদের বক্তব্য শেষে প্রকল্পের অংশগ্রহণকারী ৯৫০ জনের মধ্যে চার জনের হাতে সনদ তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
সনদ গ্রহণ করেন নাটোরের মোঃ সাব্বির হোসেন, উম্মে হাবিবা সাথী এবং পাবনার মোঃ ইসহাক আলী ও জান্নাতুল ফেরদৌস। এছাড়াও ফ্রিল্যান্সার থেকে উদ্যোক্তা হওয়া ৬ ব্যক্তি সিংড়া শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিবেশন সেন্টারে প্রধান অতিথির কাছ থেকে স্থান বরাদ্দের বরাদ্দ পত্র গ্রহণ করেন। ডিজিপ্রো ডিজিটাল, নকরেক আইটি, কোডার ট্রাস্ট, এনফিভশন, জামান আইটি এবং শিখবো আমরাই।
এসময় গোল-ই আফরোজ সরকারি অনার্স কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো: ফরহাদ হোসেন, সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা খাতুন ও বিদায়ী নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম সামিরুল ইসলাম, মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, সিনেমা-নাটকে দেখি শিক্ষিত বেকার তরুণীরা চাকুরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘোরে। তাদের স্যান্ডেলের তলা ক্ষয়ে যায়। কিন্তু চাকরি হয় না। মামা-চাচা, প্রভাবশালী নেতা, সুপারিশ ও তদবির না থাকলে চাকরি হয় হয় না। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিগত ১৪ বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ তৈরি করে দেয়ায় আমি আজ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে চাই, যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ ও দক্ষতা অর্জন করলে বাংলাদেশের কোনো শিক্ষিত তরুণ-তরুণী ইনশাআল্লাহ বেকার থাকবে না।
সূর্যের মতো জ্বলে-পুড়ে পৃথিবীকে আলোকিত করতে উপস্থিত তরুণদের প্রতি আহ্বান জানান আইসিটি প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, দেশের ৫ কোটি ছাত্র-ছাত্রীই ২০৪১ সালের শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপ স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবে। সেই জন্য আমরা দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলার দিকে নজর দিচ্ছি।
তিনি বলেন, তরুণ প্রজন্মকে জব ক্রিয়েটর হিসেবে গড়ে তুলতে ডিজিটাল বাংলাদেশের আর্কিটেক্ট জয় ভাইয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী মাছ উপহার দেয়ার চেয়ে শিকারের কৌশল শেখানো হচ্ছে। এই সুযোগটা নিয়ে তোমরা আত্মসম্মানের সঙ্গে বাঁচবে। সূর্যের মতোই জ্বলবে।
এসময় দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের শক্তি ও তারুণ্যের মেধাকে কাজে লাগিয়ে সেল্ফ লার্নিংয়ের মাধ্যমে ক্যারিয়ার গড়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রতিমন্ত্রী।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে আমরা আরো ১০ লাখ আইটি ফ্রিল্যান্সার আমরা বাংলঅদেশের মাটিতে তৈরি করতে পারবো। এর ফলে বর্তমানে আইসিটি খাতের রপ্তানি আয় দেড় বিলিয়ন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পারবো। বিশ্বে মেধাভিত্তিক উদ্ভাবনী দেশ হিসেবে পরিচিত হবে বাংলাদেশ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যের পর ফ্রিল্যান্সিংয়ের হাতি খড়ি নিয়ে আলোচনা করেন আপওয়ার্কের ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে সফল নারী ফ্রিল্যান্সার জয়ীতা ব্যানার্জী। তিনি জানান, মোবাইলে কখনো ফ্রিল্যান্সিং করা যাবে না। তবে শেখা ও প্রাক্টিস করা যাবে মোবাইল থেকেই।
এরপর আলোচনায় নকরেক আইটির সিইও সুবীর নকরেক নিজের ফ্রিল্যান্সিং যাত্রার কথা তুলে ধরে বলেন, মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তরুণদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবসময় দৃঢ় থাকতে হয়।
এছাড়াও ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের নিয়ে নর্দান আইটি ইনস্টিটিউশনের প্রধান নির্বাহী দিনা ম্রি, গ্রাফিক্স ডিজাইন নিয়ে হিমালয় নকরেক এবং ওয়েব ডেভলপমেন্ট ও ডিজিটান নিয়ে প্রাঞ্জল নকরেক।
নারী ফ্রিল্যান্সারদের অপার সম্ভাবনার ওপর বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সফল ফ্রিল্যান্সার থরমা তৃষ্ণা দিও। মাদ্রাসায় পড়েও কীভাবে ডলার আয় করেন সেই বাস্তবতা তুলে ধরেন সফল ওয়েব ডেভলাপার ও ফ্রিল্যান্সার মোঃ মিনহাজ উদ্দীন। শেরপুরের এই যুবক জানালেন, আমার বন্ধুবান্ধবরা মাসে ২০ হাজার টাকা আয় করলেও আমি এলাইসিটি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কওমী মাদরাসায় পড়েও এখন আপওয়ার্ক ও ফাইবার থেকে মাসে ২০-২৫ হাজার ডলার আয় করি।
তার পরেই আপওয়ার্ক এর লিড ম্যানেজার (অপারেশন) সাইদুল মামুন খান ভয়কে জয় করে কীভাবে ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল হওয়া যায় সেই বিষয়টি তুলে ধরেন আলোচনায়।
জুমার বিরতীর পর বিকেলে বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য সবচেয় চাহিদাসম্পন্ন দক্ষতা কোনগুলো তার ওপর আলোকপাত করেন কোডার ট্রাস্ট এর প্রশিক্ষক সৌম্য সুপ্রিয়া। তিনি জানালেন, ফ্রিল্যান্সিংয়ে ইউজার এক্সপেরিয়েন্স ও ওয়েব ডেভলপমেন্টে সর্বোচ্চ ৮ হাজার মার্কিন ডলার আয় করা যায়। এছাড়াও সফটওয়্যার উন্নয়নে সাড়ে ৭ হাজার, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টে ৭ হাজার, অ্যাকাউন্ট ম্যানেজমেন্টে ৬ হাজার
বিজনেস অ্যানালিস্টে সাড়ে ৫ এবং কনটেন্ট ক্রিয়েশনে ৫ হাজার ডলার আয় করা সম্ভব।
এরপরও অ্যাকাউন্ট ও বুক কিপিংয়ে ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে আলোচনা করেন আপওয়ার্ক এর টপ রেটেড সেলার উৎপল কুমার।
আর ফ্রিল্যান্সার সফলতার গল্প আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন ডোমেইন ও ওয়েব হোস্টিং সার্ভার ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তায় সেরা ফ্রিল্যান্সার শিশির আহমেদ, ডিজাইনার এবি সিদ্দিক, এসইও এক্সপার্ট হাসিবুন হাসান এমিলি, ওয়েব ডেভেলপার সোলায়মান হায়দার এবং কাজ ৩৬০ প্রতিষ্ঠাতা এমরাজিনা ইসলাম।
বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় কুইজ ও পুরস্কার বিতরণী। বিজয়ীরা হলেন- সুপার হোসেন, সাদিয়া সুলতানা মিম এবং তুর্য। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন সিংড়া পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস। সমাপনী বক্তব্যে তিনি বলেন, আমাদের অনেকেই খুব সহজেই টাকা আয় করতে চান। কষ্ট করতে চান না। কিন্তু যারা শেষ পর্যন্ত লেগে থঅকেন তারাই সফল হন।
এভাবেই বাংলাদেশের প্রথম কোনো উপজেলা হিসেবে সিংড়ায় অনুষ্ঠিত হলো আইসিটি ফ্রিল্যান্সিং ক্যাম্প। আর শনিবার চাকরি মেলার মধ্য দিয়ে শেষ হবে দুই দিনের এই ক্যারিয়ার উৎসব।