মৃত্যু মানেই প্রস্থান নয়; তারই স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। আজ থেকে ২০ বছর আগেই গ্রাম-শহরের সংযুক্তির কাব্য রাচনা করে দিয়ে গেছেন স্মার্ট বাংলাদেশের ভিত। এমনটাই মনে করেন আজ থেকে ১৪ বছর আগে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানো গ্রামীণ অবকাঠামোর রূপকার কামরুল ইসলাম সিদ্দিক এর স্মৃতিধন্য প্রাজ্ঞজনেরা। সময়ের আগে ছুটে চলাই এই অক্ষয় প্রাণপুরুষের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে যথাযথ ভাবে সম্মান জানাতে না পাড়ার লজ্জা লুকিয়ে একসময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা এবং বর্তমানে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী সভাপতি ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলছিলেন, ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে আমার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিলো। দূর থেকে দেখলে আজ বাংলাদেশের যে বহুমাত্রিক উন্নয়ন হয়েছে সেখানে তাঁর মেধা-মনন ও একনিষ্ঠ ভূমিকার যোগ্য মর্যাদা বা স্বীকৃতি আমরা তাকে আজো দিতে পারিনি। এটা আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতা।
‘সেইসময়েই তিনি স্মার্ট শব্দটা নতুন করে তুলে এনেছিলেন। প্রচলিত ও চটুল ধারণা থেকে বেরিয়ে তিনি স্মার্টনেসের একটি সংজ্ঞা তুলে ধরেছিলেন। তাঁর কাছে স্মার্টনেস ছিলো ‘সবসময় সমাধানমুখী চিন্তা, শুধু সমস্যার বয়ান দেয়া নয়’;দেশীয় প্রেক্ষাপটেই সমাধান বের করা’- যোগ করেন তিনি।
এর উদাহরণ দিয়ে তিনি জানান, প্রথম কানেক্টিভিটি রেভ্যুলেশন ঘটিয়ে তিনি ২০০১ সালেই ইউনিয়ন পরিষদের অফিসগুলোতে সরকার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সংযুক্ত করে তথ্য-প্রযুক্তির জগতে ‘ঘাট’ বা কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। যখন ব্রডব্যান্ড বা ডিজিটাল সংযোগ হয়নি, তারপরও তিনি গোবিন্দগঞ্জ, বগুড়া, পাঁচবিবি, শেরপুর, কুষ্টিয়াসহ উত্তরবঙ্গে এরকম ১০টি ‘ঘাট’ থেকে তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক সেবা দেয়ার কেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই অর্থে আজকের ডিজিটাল তথ্য সেবা কেন্দ্র ধারণাও কিন্তু তিনি শুরু করেছিলেন।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে দেশের সবচেয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, তার পরিকল্পনা ও ধারণার সঙ্গে বর্তমান সরকার একাত্মতা প্রকাশ করার ফলে আমরা আজকের সুফল পাচ্ছি। কিন্তু এটা পুরোপুরি করে দেখানোর যে সম্ভবনা ছিলো তা তিনি করে দেখানোর পরেও বর্তমানে লাভের মতো ক্ষুদ্র চিন্তাকে প্রধান্য দেয়ায় আমরা তাঁর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারিনি। যেমন তিনি বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ওয়াটার পার্টনারশিপের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের চেয়ারম্যান থাকার সময় খরা ও বন্যার প্রতিরোধে তাঁর স্বপ্নটি এখনো সুরক্ষিত হয়নি। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আজকে নদী অশান্ত হচ্ছে। অকাল বন্যায় নাকাল হতে হয়েছে কিছুদিন আগেই। এছাড়াও তাঁর হাত ধরেই এদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানী হিসেবে বিদ্যুতের বিকল্প উৎস হিসেবে সৌর বিদ্যুৎ প্লান্ট শুরু হয়েছিলো। যার ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি পর্যায়ে সৌর শক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ বিশ্বে সবচেয়ে বড় গ্রাহক। সরকার শ্রেডার মাধ্যমে এই প্রকল্প বাড়ানোয় আজ বিদ্যুৎ সঙ্কটে এর সুফল মিলছে।
এমন বেশ কয়েকটি কারণে কামরুল ইসলাম সিদ্দিক সবসময়ের জন্য ‘রোল মডেল‘ হয়ে থাকবেন উল্লেখ করে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, উনি গ্রাম-বাংলার রূপান্তরে বিশাল একটা ভূমিকা রেখেছেন। অনেক আগে থেকেই তিনি বুঝেছিলেন অর্থনৈতিক অনগ্ররসরতার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। এটা দূর করে গ্রাম-শহরের সংযোগ সৃষ্টিতে তিনি ফিডার রোড করে দিয়ে দেশের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জগতের সীমানা বহুগুণ বাড়িয়ে তা বিশ্ব পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। কেননা গ্রামের মানুষেরাই আজ বিশ্বে বিভিন্ন দেশে গিয়ে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। গ্রাম ও শহরের সংযোগে উনি অনন্য। তবে তারচেয়েও বড় কথা; পাবলিক সার্ভেন্ট বা আমলা বা পেশাজীবি যাই বলি না কেন ক্ষুদ্র স্বার্থ বড় আকাঙ্ক্ষার ঊর্ধ্বে উঠে কামরুল ইসলাম সিদ্দিক উজ্জ্বল নক্ষত্র। উনাকে আমাদের কর্মবীর বলা উচিত। কেন উনি শুধু প্রকল্প শুরু করেননি তা সময় মতো শেষ করে নজির স্থাপন করেছেন। এভাবেই তিনি এলজিইডি’র প্রকৌশলীদের ভিন্ন একটা মন-মানসিকতার পেশাজীবি হিসেবে গড়ে তুলতে সফল হয়েছিলেন।
অনবদ্য ভূমিকা রাখার পরেও তাঁর জাতীয় স্বীকৃতি না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে বেসরকারি সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা এই গুণী অর্থনীতিবিদ বললেন, তবে আমি খুবই দুঃখ পাই যারা সত্যিকার অর্থে ভূমিকা রেখেছে তাঁদের কীর্তিগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারিনি। তাঁকে কোনো ধরনের স্বীকৃতি দিতে পারিনি। মূল্যায়ন করিনি। এটা আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা। আশা করছি, দেরিতে হলেও এই ব্যর্থতা আমরা সমষ্টিকভাবে অতিক্রমের চেষ্টা করবো।
কেন এখনো যোগ্য মর্যাদা পান নি এই বহুমাত্রিক গুণী ব্যক্তিত্ব- এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশী ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত অনেকটাই হতাশার সুরে বললেন, উনি ছিলেন প্রকৌশলী। আর এখন দেশ চালায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটররা। বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডার। অ্যাডমিনক্যাডাররা ইঞ্জিনিয়ারদের অপছন্দ করে। তাই তার যোগ্য মর্যাদা বা সম্মান পাওয়াটা প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই দেশ তার জন্য রেডি না।
প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক এর জন্ম ১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি কুষ্টিয়া জেলায়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে শুরু করেন কর্মজীবন। ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জীবন গড়ার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে হাতে তুলে নেন অস্ত্র। নয় মাস মুক্তি সংগ্রামে বিজয়ের পর নতুন করে শুরু করেন দেশ গড়ার সংগ্রাম।
স্নেহের দুই নাতি ও নাতনীর সঙ্গে সস্ত্রীক কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। ছেলে সাইফুল ইসলাম সিদ্দিকের নিউজার্সির বাসায় মৃত্যুর কিছুদিন আগে
১৯৭৭ সালে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবান এন্ড রিজিওনাল প্ল্যানিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। এলজিইডির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে নিরলস পরিশ্রম করে হয়ে ওঠেন অবকাঠামো উন্নয়নের প্রবাদ পুরুষ। ১৯৯৯ সালে পিডিবির চেয়ারম্যান হিসেবেও সফলতার স্বাক্ষর রাখেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। আধুনিক নগর কাঠামো গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল তার। তিনি কেবল স্বপ্নদ্রষ্ট্রাই ছিলেন না, ছিলেন স্বপ্ন বাস্তবায়নের কারিগরও।
বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য বিশ্বব্যাংক কামরুল ইসলাম সিদ্দিককে ১৯৯৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল রোড ফেডারেশন কর্তৃক বর্ষসেরা ব্যক্তি ঘোষণা করেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ভাসানী স্বর্ণপদক, কবি জসীম উদ্দীন স্বর্ণপদক, আইইবি স্বর্ণপদক, শেরেবাংলা স্বর্ণপদক, বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী স্বর্ণপদকসহ বহু পুরস্কার।
২০০৮ সালের আজকের দিনে (১ সেপ্টেম্বর) কর্মচঞ্চল এই মানুষটি ৬৩ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। অমৃত্যু নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রচারবিমুখ এই মানুষটি। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক তাঁর কাজের মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকবেন দেশের মানুষের মাঝে। ডিজিবাংলা পরিবার ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। শ্রদ্ধা জানাচ্ছে বাংলার গ্রাম, প্রান্তিক মানুষসহ গোটা বাংলাদেশ। জাতীয়ভাবে কোনো অনুষ্ঠান না হলেও তার হাতে গড়া এলজিইডিতে বিকেলে হয়েছে দোআ অনুষ্ঠান।