অংশীজনদের নিয়ে দফায় দফায় কর্মশালা এবং ফোকাস গ্রুপ আলোচনার মাধ্যমে প্রণীত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট নীতিমালা অর্থবহ ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে নীতিমালায় সংযোগের পাশাপাশি কনটেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়কে অন্তর্ভূক্ত করায় সাধুবাদ জানিয়ে নীতিমালায় শিশু ও কিশোর এবং ফ্রিল্যান্সারদের বিষয় অন্তর্ভূক্তির আহ্বান জানিয়েছেন গবেষকরা।
বৃহস্পতিবার বিটিআরসি সম্মেলন কেন্দ্রে ফোকাস গ্রুপ সভায় এমন অভিমত তুলে ধরেছেন অংশগ্রহণকারীরা। বক্তাদের পরামর্শকে সাদরে গ্রহণ করে নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে বলে জানান বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার। সভাপতির বক্তব্যে তিনি মিনিংফুল কানেক্টিভিটিসহ ইনক্লুসিভ, অ্যাক্সেসিবিলিটি, অ্যাফোর্ডেবিলিটি’র সঙ্গা ও আওতা অন্তর্ভূক্তির পরামর্শ দেন।
তিন ঘণ্টা স্থায়ী এই সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, সবার আলোচনায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, ইন্টারনেট, ইন্টারনেট এবং ইন্টারনেট সামনে যাওয়ার সবচেয়ে বড় বাহন। তাই কেবল লোক দেখানোর বিষয় নয়; ব্রডব্যান্ড নীতিমালা অনুযায়ী গুরুত্ব দিয়েই স্টেক হোল্ডারদের কেউই যেন বাদ না পড়েন সে জন্যই এই ফোকাস গ্রুপ আলোচনা সভা ভূমিকা পালন করবে। আমরা কেবল পুরুষ বা সবল মানুষের জন্য নীতিমালা করি নাই। এটা সবার জন্য আমরা সচেতনতা ও দক্ষতার সহজলভ্য পথ খুঁজে বের করছি।
মন্ত্রী আরো বলেন, আমরা ইতিমধ্যেই গ্রাম পর্যন্ত ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়ার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এর পরে গ্রাম থেকে বাড়ি বাড়ি ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়ার কাজ শুরু হবে। অতিদ্রুত মোবাইল ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও এক দেশ এক রেট এর মতো একটা ব্যবস্থা করতে পারবো।
এছাড়াও অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন এ৪এআই এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান অঞ্জু মঙ্গল। এসময় সবার অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নীতিমালা ফলপ্রসু হয়না উল্লেখ করে এই ফোকাস গ্রুপ সভা সবার জন্যওই অর্থবহ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সভায় জাতীয় ব্রডব্যান্ড নীতিমালায় নারী, প্রতিবন্ধী, যুব, বাস্তুচ্যুত ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতামতের প্রতিফলন নিয়ে বিটিআরসি’র উদ্যোগ তুলে ধরেন বিটিআরসি’র সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিস বিভাগের পরিচালক সাজেদা পারভীন।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন উইমেন ইন ডিজিটাল প্রতিষ্ঠাতা আছিয়া নিলা। তিনি জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের ৩৮ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেটে সংযুক্ত। গত বছরের তুলনায় এই কয় মাসেই দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বেড়েছে ১ শতাংশ। এমন পরিস্থিতে বিশেষ কোনো গোষ্ঠী নয় আগামী বৈঠক সকলের জন্য হবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি। অনুষ্ঠানে ডিজিটাল স্বাক্ষরতা এবং প্রযুক্তি দক্ষ মানুষ গড়ে তুলতে বেশ কিছু প্রস্তাবনা পেশ করেন।
সভা সঞ্চালনা করেন বিটিআরসি’র উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফারহান আলম। সভায় জাতীয় ব্রডব্যান্ড নীতিমালা ২০২৩ এর খসড়া উপস্থাপন করেন বিটিআরসি মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসিম পারভেজ। তিনি জানান, এই নীতিমালার অধীনে সবার জন্য ডিজিটাল সেবা প্রাপ্তির সমান অধিকার নিশ্চিত হবে। দেশীয় সফটওয়্যার, অ্যাপ্লিকেশন ও কন্টেন্টের খাত সম্প্রসারিত হবে। সমৃদ্ধ হবে পরিকল্পিত অবকাঠামো, বিনিয়োগ ও অংশীদারিত্ব। জোরদার হবে কার্যকর সাইবার নিরাপত্তা। পাঁচ বছর পর পর রিভিউ করা হবে এই নীতিমালা।
এছাড়াও ডিজিটাল বৈষম্য দূর করতেই বিটিআরসি স্বপ্রণোদিত হয়ে দায়িত্ব পালন করছে বলেও জানান বেশ নীতিমালা প্রণয়নে নেতৃত্বদানকারী এই কর্মকর্তা।
এরপরই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এটুআই ন্যাশনাল কনসাল্টেন্ট ভাস্কর্য ভট্টাচার্য এই উদ্যোগকে ‘প্রো-পিপুল অ্যাক্টিভিটি’ বলে অভিহিত করেন। ব্রডব্যান্ড নীতি মালায় অক্ষম ব্যক্তির জন্য সংযোগ ও কনটেন্টে ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি। আক্ষেপ প্রকাশ করেন দেশের কোনো মোবাইল অপারেটরই তাদের সেবায় অক্ষম ব্যক্তিদের উপযোগী সেবা দেয় না।
বক্তব্যে করোনার সময়ে ইনক্লুসিভ টেকনোলজি নিয়ে গবেষণা অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক নোভা আহমেদ। তিনি বলেন, কেবল প্রযুক্তি থাকলেই হবে না, প্রশিক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রান্তিক মানুষের কাছে প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি এর ব্যবস্থাপনায়ও নজর দিতে হবে।
সভায় আরো বক্তব্য রাখেন বিটিআরসি ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ইয়্যুথ ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরামের ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়াদ হাসান বাদশা, ই-ক্যাব অর্ণব মোস্তাফা, সেক্রেটারি ফয়সাল আহমেদ ভূবন, বেসিস উপদেষ্টা কমিটির সদস্য রেজওয়ানা খান, অ্যাকসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অ্যালবার্ট মোল্যা, সৈয়দা তামিম জাহান রিপা, ফ্রিল্যান্সাররে প্রতিনিধি আশিকুর রহমান শুন্য ও গবেষক রাহাত জাহাঙ্গীর।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বিটিআরসি’র কমিশনার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন, শেখ রিয়াজ আহমেদ ও সচিব নূরুল হাফিজ এবং আইএসপিএবি প্রতিনিধি মার্জিয়া, বাংলালিংক থেকে নুসরাত শরীফ, রবি থেকে এম এ ফারহানা মঞ্জুর, গ্রামীণ ফোন প্রতিনিধি তাজরিবা খুরশীদ ও অ্যাডভোকেট মুন।
সভায় গ্রামীণফোনের প্রতিনিধি তাজরিবা খুরশিদ বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে কানেক্টিভিটি ও সাশ্রয়ী ডিভাইস নিশ্চিতসহ তরুণ ও নারীদের ডিজিটাল মার্কেটিং ও সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইশজেশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। রবি আজিয়াটা লিমিটেড এর প্রতিনিধি জেবা ফারিবা বলেন, মানসম্মত ডিভাইসের সহজলভ্যতা ইন্টারনেট গ্রাহক সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলালিংক থেকে আগত প্রতিনিধি বলেন, প্রতিবন্ধী ও নারীসহ পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর চাহিদাসমূহ তুলে ধরতে পারলে তা মোবাইল অপারেটরসমহূ সে অনুযায়ী তাদের সেবা দিতে পারবে। টেলিটকের পক্ষ থেকে শাকিলা বিশ্বাস বলেন, হাওড়-বাওড় এলাকায় টেলিটক তাদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করছে। এছাড়া সুন্দরবনে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের ফলে জেলেরা মোবাইল নেটওয়ার্ক সুবিধা পাচ্ছে। নারীদের জন্য টেলিটক আলাদা প্যাকেজ চালু করছে বলেও জানান তিনি।