ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে প্রথম এক বছরে টাকা ফেরত দেওয়ার যে গতি ছিল, দ্বিতীয় বছরে প্রথম বছরের ২৫ শতাংশের মতো টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি ২০২৪) দুপুরে ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটের নসরুল হামিদ মিলনায়নে অনুষ্ঠিত হলো ই-কমার্স ও ই-সেবা খাতে ভোক্তার অধিকার ও আমাদের করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভা।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে ই-কমার্স খাত পূণর্গঠিত ও ঘুরে দঁড়াচ্ছে এমন আভাস দিয়ে ভোক্ত অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ‘হলুদ সাংবাদিকতা হলে ই-কমার্স আবার মুখ থুবড়ে পড়বে’ – এমন সতর্ক বার্তা দিয়ে ‘নেগিটিভ নিউজ করুন কিন্তু ফেক নিউজ দিয়ে ডিমোরালাইজড করেন না’ বলে গণমাধ্যম কর্মীদের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, ২০২১ সালে ই-কমার্সে প্রতারণা নিয়ে উত্তাল ও বিক্ষভে ফেটে পড়েছিলো ভোক্তারা। প্রতারণা করে অনেকেই দুবাই, সান্তিয়াগো ও ভারতে পালিয়ে যায়। সেই প্রেক্ষাপট থেকে একটি এসওপি করায় কিছুটা হলেও স্ক্যামারদের টাকা সরানো বন্ধ করা হয়। এর ফলে এসক্রোতে আটকে রাখা টাকা ফেরত দেয়ার হিসাব তুলে ধরে তিনি জানান এই মুহুর্তে ৩৮৬ কোটি টাকা ভোক্তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কিউকম ৩০৮ কোটি, আলিশা মার্ট ৪০ কোটি ৬৭ লাখ, দালাল প্লাস ১৮ কোটি এবং ই-ভ্যালি ১০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে।
এসব টাকা ফেরত দিতেই কিউকম রিপনকে জেল থেকে জামিনে মুক্ত করতে নিজের উদ্যোগের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, এখনো তার ৭০ কোটি টাকা আটকে আছে তা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাদেরকে ব্যবসায় ফিরিয়ে এনেই আমরা এভাবে টাকা ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করছি। এছাড়াও ফেসবুকে প্রতারণার শিকার মোট ৫৮৭৯টি অভিযোগের মধ্যে ৫৭২২টি নিষ্পত্তি করেছি। নিষ্পত্তির হার ৯৭.৩৩ শতাংশ। বাকি যেগুলো নিষ্পত্তি হয়নি মূলত তাদের ট্র্যাক করা যাচ্ছে না। এই কারণে বিটিআরসি’র সহায়তায় পেজগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।
সফিকুজ্জামান আক্ষেপ বলেন, ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্টে একজন স্টুডেন্ট যখন ১০০ মোটর সাইকেল অর্ডার করে তখন তো ই-কমার্স খাত একসময় মুখ থুবড়েই পড়বে। রিং আইডির মতো গ্যাম্বলিং সাইটকে যদি ই-কমার্স বলা হয় তখন কী করার থাকে! জম জমের পানি, রিয়াজুল জান্নাহ’র জায়নামাজ বিক্রি হয় না। যারা ফেসবুকে এসব বিক্রি করেন তাদের পাশাপাশি এসব কেনার ক্ষেত্রে ভোক্তাদের এ জন্য সচেতন হতে হবে।
ই-কমার্সে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ক্যাশ অন ডেলিভারি ছাড়া পণ্য ডেলিভারি বন্ধ রাখা, ডিবিআইডি’র মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের সহজে বিনা ফিতে নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালুর কথাও উল্লেখ করেন তিনি। তবে মাত্র ৮০০ জন ডিবিআইডি-তে নিবন্ধন করার বিষয় ই-ক্যাবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা বাড়ানোর পরামর্শ দেন। ডাক বিভাগের মাধ্যমে ডেলিভারি পণ্য সনাক্তে সিএলটিপি অ্যাপস তৈরি করা হয়েছে। একইসঙ্গে আসন্ন ভোক্তা দিবসে ভোক্তাদের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ‘সিসিএমএস’ (কঞ্জুমার কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) দেশজুড়ে চালু করা হবে। আগামী ১৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করবেন। এছাড়াও শিগগিরই ই-কমার্স অথরিটি গঠনের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। এটি এখন মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
– এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, মহাপরিচালক, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের পরিচালক গাজী গোলাম তৌসিফ, ক্যাব ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন, আইএসপিএবি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসোন আনু, ই-ক্যাব ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. সাহাব উদ্দিন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
আলোচনা সভার শুরুতেই মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বাজার বিশ্লেষক কাজী আব্দুল হান্নান জানান, ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ই-কমার্সের বাজার আকার হবে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু দেশে ই-কমার্স আইনের অনুপস্থিতিতে এই খাতে একটি লুটেরা বাহিনী গড়ে উঠেছে। এই খাতে শৃঙ্খলা আনা গেলে, বিনিয়োগ, আয় ও কর্মসংস্থান বাড়বে।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ই-ভ্যালি প্রতিষ্ঠাতা সিইও মোহাম্মাদ রাসেল, ই-কুরিয়ার সিইও বিপ্লব ঘোষ রাহুল প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে পণ্য ছাড় দেয়ার পরও গেটওয়েতে টাকা আটকে দেয়ার কারণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এসময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে -ক্যাব ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. সাহাব উদ্দিন বলেন, কিউকম এর ক্ষেত্রে যারা টাকা পাবেন তাদের অনেক কিছুই ভেরিফিকেশন ইস্যুতে আটকে আছে। ফস্টার থেকে কাস্টমারদের ডাটা ভেরিফিকেশনে জটিলতা আছে। এছাড়াও অনেকগুলো কোম্পানি আসতে বলেও ধরা না দেয়ায় তা দেরি হচ্ছে। আমরা লেগে থাকায় ৫২৫ কোটি টাকার মধ্যে ৩৮৭ কোটি টাকার বেশি ছাড় দেয়া হয়েছে। এখন নগদসহ পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর সহযোগিতা দরকার।
ই-ভ্যালি সিইও মোহাম্মাদ রাসেল বলেন, যদি আপনারা চান গ্রাহকরা টাকা ফেরত পাক তাহলে আমার ওপর বহিরাগত চাপ না দিয়ে ব্যবসা করতে দিন। আমি জোর গলায় বলছি, বাংলাদেশের প্রতিটি ই-ক্যাবের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক শিগগিরই তাদের টাকা ফেরত পাবে।
ই-করিয়ার সিইও বিপ্লব বলেন, ই-কমার্স একটা পজেটিভ মুভমেন্টের দিকে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোক ঘরে বসেই পণ্য পাচ্ছেন। এ জন্য সরকার, আইনি প্রয়োগকারী সংস্থা, উদ্যোক্তা, ডেলিভারি পার্সন সবাইকে একই সঙ্গে করতে হবে। এটাকে যত পজিটিভ ভাবে নেয়া যাবে তত ইতিবাচক হবে।
সভাপতির বক্তব্যে মহিউদ্দিন বলেন, আমরা গ্রাহক, উদ্যোক্তা ও রাষ্ট্র প্রত্যেকের স্বার্থ রক্ষাতেই কাজ করি। সবার সুরক্ষা নিয়ে সোচ্চার থাকি। আমরা সকল পক্ষকে নিয়ে সমস্যার সামধান করতে চাই।