বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন, পরিবর্তন ও প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ নামে নতুন একটি আইন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নতুন আইনে ডিজিটাল মাধ্যমে মানহানিকর তথ্য প্রচার ও প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আর কারাদণ্ডের বিধান থাকছে না। কারাদণ্ড বাতিল করে সেখানে শাস্তি হিসেবে জরিমানা রাখা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে সোমবার ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বিলুপ্ত নয়, নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে।
জানা গেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় মানহানির বিষয়টি রয়েছে। এতে বলা আছে, যদি কোনও ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোডের (দণ্ডবিধি) সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, সে জন্য তিনি অনধিক তিন বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর যদি কোনও ব্যক্তি উপধারা (১)-এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। প্রস্তাবিত আইনে এই অপরাধের জন্য কারাদণ্ড বাদ দিলেও জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।
এ ছাড়া নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাইবার নিরাপত্তার জন্য যেসব ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল, সেই ধারা প্রস্তাবিত আইনে অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে। তবে অনেকগুলো ধারা পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন আইন অনুযায়ী একটা সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সি থাকবে। এছাড়া আগের আইনে জেলের বিধান বেশি ছিল। নতুন আইনে জরিমানার পরিমাণ বেশি রাখা হয়েছে। নতুন আইনে জামিনঅযোগ্য ধারাগুলো হচ্ছে— ১৭, ১৯, ২১ ও ৩৩। আর জামিনযোগ্য ধারাগুলো হচ্ছে— ১৮, ২০, ২২, ২৪, ২৬, ২৮, ২৯। ভেটিং (আইন মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাই) শেষ করে আবার মন্ত্রিপরিষদে আসবে আইনটি।
আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আইনটিকে ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক মন্ত্রিসভায় নতুন আইনটি উত্থাপন করেন।’
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়নি, পরিবর্তন করা হয়েছে। যদি এখন বলি, বাতিল করা হয়েছে, তাহলে আপনারা প্রশ্ন করবেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রায় সব ধারাই তো এ আইনে আছে। তাহলে আপনি কেন বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। যে কারণে আমি পরিবর্তন শব্দটি ব্যবহার করেছি।’
তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল প্রগ্রেস (অগ্রগতি) সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে আইনটির নাম দেওয়া হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা আইন। এ আইনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, সাইবার নিরাপত্তার জন্য যেসব ধারাগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল, সেগুলো এখানে অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। সেগুলোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।’
‘দ্বিতীয়ত, যেটা করা হয়েছে- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেকগুলো ধারা, যেমন মানহানির যে ধারাটা ছিল, সেই ধারায় আগে শাস্তি ছিল কারাদণ্ড। সেই কারাদণ্ডের জায়গায় এখন জরিমানার বিধান করা হয়েছে। অর্থাৎ মানহানির একমাত্র সাজা জরিমানা। এখন জরিমানা যদি না দেওয়া হয়, তাহলে কারাদণ্ড থাকবে। সেটাও জরিমানার ওপর ভিত্তি করে তিন মাস বা ছয় মাসের কারাদণ্ড থাকবে। কিন্তু মূল শাস্তি হচ্ছে জরিমানা। জরিমানা আগে সর্বোচ্চ ছিল ৫ লাখ টাকা, এখন তা বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা করা হয়েছে।’ বলেন আইনমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘এখানে অনেকগুলো ধারা যেগুলো আগে অজামিনযোগ্য ছিল, সেগুলোকে (সাইবার সিকিউরিটি আইন) জামিনযোগ্য করা হয়েছে।’
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২১-এ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের পতাকা ও জাতীয় সংগীত- এসব নিয়ে যদি কেউ কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে, তাহলে সেটাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। সেটির সাজা ছিল ১০ বছর কারাদণ্ড, সেটিকে কমিয়ে এখন সাত বছর করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অনেকগুলো ধারার মধ্যে ছিল, দ্বিতীয়বার যদি কেউ অপরাধ করে, তাহলে সেই সাজা দ্বিগুণ হয়ে যেত কিংবা সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হতো। প্রত্যেকটা ধারায় যেখানে দ্বিতীয়বার অপরাধের সাজার কথা আছে, সেগুলো বাতিল করা হয়েছে। নতুন আইনে দ্বিতীয়বার অপরাধ করলেও প্রথমবারের অপরাধে যে সাজা থাকবে, দ্বিতীয়বারের জন্যও একই সাজা থাকবে।’
আনিসুল হক বলেন, ‘যেগুলো টেকনিক্যাল অপরাধ, যেগুলো সাইবার সিকিউরিটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোর ব্যাপারে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু অপব্যবহার কিংবা মিসইউজ রোধ করতে আমরা নাম পরিবর্তন করেছি। যেমন- আগে মানহানিতে কারাদণ্ড ছিল, সেখানে এখন কারাদণ্ড নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকলে একটা মানসিক চাপ থেকে যায়। স্বাধীন সংবাদ পরিবেশনে একটি মানসিক চাপ থাকে। সেটাকেও আমরা কর্তব্যের মধ্যে নিয়েছি। যে কারণে আমরা পরিবর্তন করেছি।’
‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেক জায়গায় সাজার পরিমাণ অনেক বেশি ছিল, সেটি কমানো হয়েছে। যেখানে উপধারা দিয়ে কিংবা দ্বিতীয়বার করলে সাজা দ্বিগুণ হয়ে যেত, সেই সব ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়েছে। যে কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা না, সাইবার নিরাপত্তা আইন নামেই এটি পরিবর্তন হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের রহিতকরণ ও হেফাজতকরণের প্রভিশন রেখে আমরা সাইবার নিরাপত্তা নিরাপত্তা আইন করেছি।’
তিনি বলেন, ‘যেগুলো টেকনিক্যাল ওফেন্স সেখানে কিন্তু আমরা জামিনযোগ্যও করিনি। সাজাও কমানো হয়নি। ৩০ ধারা (আইনানুগ কর্তৃত্ববহির্ভূত ই-ট্রানজেকশন এর অপরাধ ও দণ্ড) থাকবে। সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধে আগে ১৪ বছরের জেল ছিল, এখন তা ৭ বছর করা হয়েছে।’
‘পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতারের যে ধারাটি ছিল, সেটি কি পরিবর্তন হয়েছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল অপরাধের ক্ষেত্রে অনেক সময় যে যন্ত্র দিয়ে সেটি করা হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে সেগুলো জব্দ না করা হয়, তাহলে সাক্ষ্যপ্রমাণ হারিয়ে যাওয়ার একটি শঙ্কা থাকে। সে কারণে আমার মনে হয়, ৪৩ নম্বর ধারাটি থাকার প্রয়োজন। এ আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ নম্বর ধারা (পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতার) ছিল, সেটি আছে।’
তাহলে ৪৩ ধারা অনুযায়ী মামলা হলেই যে পুলিশ পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করে সে বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আনা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখন কোনো কারাদণ্ড নেই। তাহলে কেন গ্রেফতার করা হবে। গ্রেফতারের কোনো আশঙ্কাই থাকলো না। এখন আর গ্রেফতার হবে না।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাগুলো চলবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘মামলার যে কার্যক্রম সেটি সাইবার নিরাপত্তা আইনে চলবে। আগামী সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে আইনটি উঠবে, সেখানে এটি পাস করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ব্যাখ্যায় (খসড়া আইন) এখন কোনো কারাদণ্ড নেই। তো আপনাদের অ্যারেস্ট করবে কেন? অ্যারেস্ট তো করার আর কোনো আশঙ্কাই থাকলো না।’
তার মানে অ্যারেস্ট হচ্ছে না- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী বলেন, ‘না, অ্যারেস্ট হবে না।’
তাহলে মানহানির মামলার ক্ষেত্রে সরাসরি অ্যারেস্ট করা যাবে না- এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই, এটা তো আর কারাদণ্ডই না।’
নতুন আইন সাইবার ক্রাইম বন্ধে অত্যন্ত সহায়ক হবে জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা যেসব সমস্যা নিয়ে ব্লেইম করছিলেন, সেই অপব্যবহারটাও বন্ধ হবে।’
এদিকে নতুন আইনটিতে কী থাকছে, সংশ্লিষ্ট মহলে এটি নিয়ে নতুন কোনও আলোচনা-সমালোচনা হবে কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) পরিবর্তে প্রস্তাবিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ যেন কোনোভাবেই স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের হাতিয়ারে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) বাতিলে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে টিআইবি বলেছে, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ নামে নতুন যে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, তা যেন ভিন্নমত দমনের হাতিয়ারে পরিণত না হয়। আইনটি যেন শুধু সাইবার অবকাঠামোর নিরাপত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। একই সঙ্গে নতুন আইনটি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করতেও সরকারের প্রতি তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। সোমবার (৭ আগস্ট) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত এবং নতুন সাইবার সিকিউরিটি আইন নিয়ে এমন প্রতিক্রিয়া দিয়েছে টিআইবি।