ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে যে আদেশ হাই কোর্ট দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় লড়তে উপাচার্যের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। অপরদিকে এ প্রসঙ্গে বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ বলেছেন, কোনো রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ওপর যদি কোনো আদেশ আসে, তাহলে আমাদের লিগ্যাল অ্যাডভাইজারের সঙ্গে পরামর্শ করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। সেখানে যদি আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতামত নিতে হয়, তাহলে সেটা নেওয়া হবে।
ছাত্র রাজনীতি চালু করা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে সবাই বসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে এটা কীভাবে করা হবে সে বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করতে হবে।
হাই কোর্টের রায়ের বিষয়ে সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে রাজনীতির ছোবলে প্রাণ হারানো অগ্রজদের কথা স্মরণ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলেছেন, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি না থাকার আমাদের যে দাবি, তার যৌক্তিকতা নিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ এবং অটল। যেই ছাত্ররাজনীতি র্যাগিং কালচারকে প্রশ্রয় দেয়, ক্ষমতার অপব্যবহারের পথ খুলে দেয়, যার বলি হতে হয় নিরীহ ছাত্রদেরকে তা আমাদের জন্য ভালো কিছু কখনোই বয়ে আনেনি, আনবেও না। এর চরম মূল্য হিসেবে আমরা আমাদের কেমিকৌশল- ৯৯ এর সাবেকুন্নাহার সনি আপু, যন্ত্রকৌশল-০৯ এর আরিফ রায়হান দ্বীপ ভাই এবং সর্বশেষ তড়িৎকৌশল-১৭ এর আবরার ফাহাদ ভাইকে হারিয়েছি। ছাত্ররাজনীতিবিহীন বুয়েটের পরিবেশ ছিল সর্বোচ্চ নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব। মৌলবাদী শক্তিকেও আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দিতে পারি।
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ‘দেশ-বিদেশের নানাপ্রান্ত হতে বুয়েটের অ্যালামনাইরাও ইতোমধ্যে ক্যাম্পাস ছাত্ররাজনীতিমুক্ত রাখার মতামতের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে একাত্মতা পোষণ করছেন এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজ নিজ জায়গা থেকে তারা দাবির পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করছেন। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি পূর্ণ ভরসা এবং আস্থা রাখেন। তাদের কাছ থেকেই আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি, তারাই আমাদের প্রতিটি ক্লাসরুম প্রতিটি ল্যাবের নায়ক। প্রফেসর, এসোসিয়েট প্রফেসর, এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, লেকচারার যারাই আমাদের ক্লাস নিয়েছেন, আমরা গত চার বছরে এমনটা কখনো অনুভব করিনি যে তারাও চান পুনরায় ছাত্ররাজনীতি প্রবেশ করে সেই অন্ধকার দিনগুলো ফিরে আসুক। তারা কখনোই আমাদের অকল্যাণ চাননি, এবং কথনোই চাইবেনও না। তারা সবসময় শিক্ষার্থীদের পক্ষেই ছিলেন। আজ এই প্রেস ব্রিফিং এর মাধ্যমে আমরা আমাদের বুয়েটের সব শিক্ষকদের কাছে আর্জি জানাচ্ছি, তারা যাতে এমন সংকট মূহুর্তে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান।’
ভাইস চ্যান্সেলরের ওপর আস্থা পোষণ করে বুয়েট শিক্ষার্থীরা বলেন, তার (ভিসি) সদিচ্ছা সবসময় আমাদের পক্ষেই ছিল বলে আমরা বিশ্বাস করি। গত তিন দিনব্যাপী আন্দোলনের মধ্যে তিনি আমাদের সব ব্যাচের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেন, বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং আমাদের কথা শোনার চেষ্টা করেন। আমরা শিক্ষার্থীরা আমাদের মাননীয় ভিসি স্যারকে এই আর্জি জানাচ্ছি, তিনি যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষককে নিয়ে বুয়েট শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের যে আকাঙ্ক্ষা, তা সব আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূরণ করেন।
এদিকে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পক্ষে ফেইসবুকে বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী চমক হাসান লিখেছেন, “আমি বুয়েটের অ্যালামনাইদের একজন হিসেবে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে চাই। আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি বুয়েটে ছাত্র-রাজনীতি বন্ধ থাকা উচিত। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রশিবির- কিছুরই দরকার নাই। কারণ দেখানো খুব সহজ।
“দুই কলামের একটা সারণি বানানো হোক। বামপাশে থাকুক ছাত্র রাজনীতির উপস্থিতি বুয়েটে কী কী ইতিবাচক পরিবর্তন উপহার দিয়েছে তার একটা তালিকা। আর ডানপাশে থাকুক ছাত্র রাজনীতির উপস্থিতির কারণে কী কী যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে গেছে ছাত্র-শিক্ষক-প্রশাসন, তার একটা খতিয়ান। ডানপাশে আবরার, সনি এই নামগুলোর কোনো একটার যে ভার, সেটা বামপাশের সম্মিলিত ভারের চেয়েও বহুগুণে বেশি। এরপরও ডান দিকের তালিকায় র্যাগিং, অত্যাচার, চাঁদাবাজি, ক্ষমতা প্রদর্শনী, অন্যায় সুবিধাভোগ-এসবের উপাখ্যান পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যাওয়া যাবে।”
চমক হাসান বলেন, “ছাত্র-রাজনীতি কেন চাইবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা? ডিপার্টমেন্টের প্রিয় জুনিয়র আবরারকে যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল, মন থেকে সেই ক্ষত এখনও মুছে যায়নি। চেনা জুনিয়রদের সাথে যত আলাপ হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আবরার-হত্যার ঘটনার পর যখন ছাত্র-রাজনীতি নিষিদ্ধ করার হয়, তার পর থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেক শান্তিতে ছিল, আছে।
“কোনো যুক্তিতেই আবার ঐ নরক ফিরিয়ে আনার মানে হয় না। ছাত্রলীগ না থাকলে শিবির মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে- এটাও মেনে নেওয়ার মতো যুক্তি না। সহজ কথা- ছাত্র রাজনীতি নেই মানে কোনো সংগঠনেরই কার্যক্রম নেই। ছাত্রলীগও না, শিবিরও না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবাইকেই প্রতিহত করবে।”