গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারী ইউনিয়নের কয়েকজন নেতার যোগসাজশে সাধারণ কর্মচারীদের ২৬ কোটি ২২ লাখ টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এরমধ্যে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সহসভাপতি মাইনুল ইসলামের (৩৯) কাছ থেকে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকার চেক জব্দ করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গত বুধবার কুমিল্লার সদর থানার মগবাড়ি এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ।
রোববার (২৮ আগস্ট) দুপুরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী বার্ষিক লভ্যাংশের ৫ শতাংশ অর্থ কর্মচারীদের দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয়নি। ‘কর্মচারীরা স্থায়ী নয়’, ‘কোম্পানি অলাভজনক’সহ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে লভ্যাংশ দেয়নি কর্তৃপক্ষ। কর্মচারীরা বিভিন্ন সময় লভ্যাংশের দাবি করলে গত বছর প্রতিষ্ঠানটি থেকে ৯৯ জন শ্রমিককে বেআইনিভাবে ছাঁটাই করা হয়। এসব কারণে প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিকরা শ্রম আদালতে ১৯০টি মামলা করেন। কিন্তু শ্রমিকদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে কোম্পানি ও শ্রমিক ইউনিয়নের কয়েকজন নেতা যোগসাজশে মামলাগুলো প্রত্যাহার করান।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানিতে বিভিন্ন সময়ে নিয়োজিত শ্রমিক কর্মচারীদের স্থায়ীকরণ না করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ক্রমাগত নবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া শ্রম আইন অনুযায়ী বাৎসরিক লভ্যাংশের ৫ শতাংশ অর্থ ৮০:১০:১০ অনুপাতে ওয়ার্কাস প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড, শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড এবং শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে দেওয়ার কথা থাকলেও ‘কর্মচারীরা স্থায়ী নয়’ ও ‘কোম্পানি অলাভজনক’ সহ বিভিন্ন অজুহাতে লভ্যাংশ দেয়নি কর্তৃপক্ষ। এসব বিষয়ে কর্মচারীরা বিভিন্ন সময় দাবি জানালে গত বছর প্রতিষ্ঠানটি থেকে ৯৯ জন শ্রমিককে বেআইনিভাবে ছাটাই করা হয়। এসব কারণে প্রতিষ্ঠানটি শ্রমিকরা শ্রম আদালতে ১৯০টি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু শ্রমিকদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে কোম্পানির ও শ্রমিক ইউনিয়নের কয়েকজন নেতার যোগসাজশে মামলাগুলো তুলে ফেলা হয়।
এরপর গত ২৭ এপ্রিল গ্রামীণ টেলিকম ও শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী গত ১০মে ঢাকা ব্যাংক গুলশান শাখায় একটি সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। সেখানে ২০১০ সাল থেকে চলতি ২০২২ সালেরসহ প্রতি বছরের কোম্পানির মোট লভ্যাংশের ৫ শতাংশের টাকা ও এই অর্থের সুদ হিসেবে আরও ৪ শতাংশ টাকা হারে কোম্পানি থেকে এই সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্টে প্রায় ৪৩৭ কোটি টাকা জমা করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী অ্যাকাউন্টটি থেকে অর্থ উত্তোলনের জন্য গ্রামীণ টেলিকমের এমডিকে বাধ্যতামূলক সিগনেটরি এবং ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অন্য দুই সিগনেটরি হিসেবে রাখা হয়।’
তিনি বলেন, শ্রমিকদের সব পাওনাদি এই অ্যাকাউন্ট থেকেই পরিচালিত হওয়ার কথা। চুক্তি অনুযায়ী সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে শ্রমিকদের পাওনা এবং ৫ শতাংশ অগ্রিম কর ছাড়া অন্য কোনো অর্থ ছাড় করার সুযোগ নেই। কিন্তু বিধি বহির্ভূতভাবে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি, সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ আরও কয়েকজন মিলে অ্যাকাউন্ট থেকে ২৬ কোটি ২২ লাখ সরিয়ে আত্মসাৎ করে।
এর আগে সাধারণ কর্মচারীদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত ৪ জুলাই গ্রামীণ টেলিকম কর্মচারী ও টেলিকম ইউনিয়নের অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান (৩৮) মিরপুর মডেল থানায় অভিযোগ করেন। পরদিন গ্রামীণ টেলিকম কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান ও সেক্রেটারি ফিরোজ মাহমুদ হাসানকে গ্রেফতার করা হয়। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গ্রেফতার মাইনুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে ডিবি প্রধান বলেন, গ্রামীণ টেলিকমের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাকেসহ এই প্রতিষ্ঠানের আরও কর্মীদের অর্থের প্রলোভনের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ইনডেমনিটি দেওয়ার উদ্দেশ্যে গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহারের জন্য ও কর্মচারী ইউনিয়নের নিয়োজিত আইনজীবীকে অযৌক্তিক ও অতিরঞ্জিতভাবে প্রায় ১৬ কোটি টাকা ফি/পারিতোষিক প্রদান করতে উৎসাহী করে।
অন্যান্য শ্রমিকদের মতো মাইনুল ইসলাম আইনানুগভাবে প্রাপ্য চার কোটি টাকা নেওয়ার পরেও তার ডাচ বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর- ১১৫১৫৭০০৪২৯০৮ এ দুই কোটি ও ব্র্যাক ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর-২০১২০৮৩১৮০০০২-এ এক কোটিসহ অতিরিক্ত মোট তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
এছাড়া তার অন্য দুই সহকর্মী অর্থাৎ টেলিকম ইউনিয়নের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ মোট নয় কোটি টাকা হাতিয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে মাইনুল ইসলাম আরও জানায়, লভ্যাংশ পাওনা পরিশোধ, অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার প্রলোভনের পাশাপাশি গ্রামীণ টেলিকম অফিস ক্যাম্পাসে কর্তৃপক্ষ মেসেজ ছড়িয়ে দেয় যে- ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলংকার মতো হবে এবং ক্ষমতার পট পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রী হবেন গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ডক্টর ইউনূস।’
তখন শ্রমিকদের এসব মামলা কোনো কাজে আসবে না, শ্রমিকরা কোনো ক্ষতিপূরণও পাবে না। বিপরীতে তাদের চাকরি হারানো, জেল খাটাসহ অন্যান্য নির্যাতনের মুখে পড়তে হবে। মূলত এই ভয়ে ও কিছুই না পাওয়ার অনিশ্চয়তার বিপরীতে টেলিকম কর্তৃপক্ষের ৪৩৭ কোটি টাকার প্রলোভনে আইনজীবীর পরামর্শে তারা দ্রুততার সঙ্গে টাকা তুলে নেয়। আইনজীবী এই সমঝোতা বিষয়টির গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে বলে।
৪৩৭ কোটি টাকার মধ্যে ২৬ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে বাকি টাকা কোথায় গেল? প্রশ্ন করা হলে ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, বিষয়টি আমরা তদন্ত করে দেখছি।
ড. ইউনূস এর সঙ্গে জড়িত কি না জানতে ডিবি প্রধান বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা মনে করছি এর দায় তিনি এড়াতে পারেন না। তারপরেও আমরা গ্রেপ্তারদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করছি। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলব। তদন্তে যা আসবে সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।
ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, যদি এই অনিয়মের সঙ্গে আর কারও সংশ্লিষ্টতা থাকে প্রয়োজনে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ। গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগের অন্যতম হলো ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের করা শতাধিকের ওপরে মামলা, শ্রমিক নেতা ও আইনজীবীদের ঘুষ দিয়ে মামলা প্রত্যাহারের পাঁয়তারা। ঘুষ নেয়া শ্রমিক নেতাদের মধ্যে অন্যতম হলো মাইনুল ইসলাম।