জনরোষে মাঠ ছাড়লেও ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বেশ সরব বাংলাদেশ আয়ামী লীগ। বিভিন্ন ডিজিটাল ডিসপ্লেতে ভূতের মতো হাজির হওয়ার মতোই ফেসবুক ও টুইটারে চলছ নিয়মিত প্রচার-প্রপাগাণ্ডা। দীর্ঘদিন ধরেই এই মাধ্যমটিতে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে দলটি। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল পেইজকে স্বীকৃতি দেয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।
প্রায় এক দশকে পেজটিতে সাড়ে ৩০ লাখের বেশি ফলোয়ার রয়েছে। সরকারের থাকার সময় থেকে সিআরআই টিমের মাধ্যমে পরিচালিত হতো পেজটি। নেতা-কর্মীদের উদ্দীপ্ত করতে লাইভ প্রোগ্রাম, নানা ভিডিও, নিউজ ক্লিপ, দলীয় প্রধানসহ নেতাদের বয়ান প্রচার করা হতো-এতে। এখন লাইভ না হলেও ফটোকার্ড ও নানা নিউজ ভিডিও শেয়ার করে দলের নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা চলছে। প্রচার করা হচ্ছে কোথাও কোথাও ঝটিকা মিছিলের ছবি। এরই অংশ হিসেবে প্রতিদিনেই গড়ে প্রায় অর্ধডজন পোস্ট প্রকাশ করা হচ্ছে ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে। ক্ষমতাসীন সময়ের চেয়ে পোস্টের সংখ্যা চার গুণের মতো বাড়লেও রিচ বা এঙ্গেজমেন্ট ততটা বাড়েনি। একইসঙ্গে মাঝে মাঝেই ফ্যাক্ট চেকারদের কাছে ধরা পড়ছে অনেক অপ-তথ্যের কারবার।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত বুধবার বিকেল ৪টায় প্রকাশ করা হয় একটি ফটোকার্ড। একটি দৈনিক পত্রিকার খবর নিয়ে করা ওই পোস্টে লেখা হয়- ”ইউনুসের সংস্কারে বাংলাদেশ দিশেহারা। কবে মুক্তি পাবে জাতি?”
জবাবে এইচ এম আনামুল ইসলাম নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন- “আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি শিল্প কারখানার এবার বেতন বেরেছে আনন্দলন ছাড়ায় আলহামদুলিল্লাহ।” তার এই মন্তব্যে সায় দিয়েছে শতাধিক ফলোয়ার।
হুসাইন আহমেদ জালালপুরী প্রশ্ন রেখেছেন- আপার খবর কি?। লাল-সবুজ নামের অ্যাকাউন্ট থেকে লেখা হয়েছে-আমি তো টিউলিপের পতনে দিশেহারা। এমডি জুয়েল নামে একজন লিখেছেন- “শেখ পরিবার আসলেই ত্যাগী পরিবার, দুইবোনের দেশত্যাগ,পুতের বউত্যাগ, মাইয়ার জামাইত্যাগ,ভাগ্নির পদত্যাগ।” রোজলিন্ড লিখেছেন- “আওয়ামী লীগ দিশেহারা।”
এমডি আলি মনে করেন- “আওয়ামী লীগ থেকে মুক্তি পাওয়ার মতো বড় পাওয়ার এই জাতির কিছু থাকতে পারে না সবকিছু দামোদরগতি হওয়ার কারণে পিছু সবকিছুর দোষারোপ আওয়ামী লীগের”। একইভাবে আমজাদ পন্ডিত লিখেছেন- “জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বহু বার কমছিল কিন্তু আওয়ামী লীগ কমায় নাই।কারণ ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধের খরচ বিগত সময় আওয়ামী লীগ দিতো বলে।”
এভাবেই কেউ আবার তীর্যক মন্তব্যের পাশে মানসিক হাসপাতালের ঠিকানা লিখে দিয়েছেন। লিখেছেন- আমরা অতীতেও দিশেহারা হতে হতে আর গায়ে লাগে না। কেউ লিখেছেন- “এখন কি এই পেজটাই সম্বল তোমাদের?”
এভাবেই এই প্রশ্ন করে এখন রীতিমতো ট্রলের শিকার হচ্ছে দলটি। প্রকাশের ১২ ঘণ্টায় পোস্টটি ৬ হাজার রিচ হয়। এর মধ্যে ২ হাজারের বেশি পাঠক ‘হা-হা’ রিয়্যাক্ট দিয়েছেন। পোস্টের নিচে জমা পড়েছে হাজারের বেশি কমেন্ট। এসব কমেন্টে তীর্যক মন্তব্য আর প্রশ্নের শিকার হয়েছে দলটি।
এর আগে গতবছরের জুনে সংঘবদ্ধভাবে অসত্য প্রচারের অভিযোগে বাংলাদেশের ৫০টি ফেসবুক আইডি ও ৯৮টি পেজ বন্ধ করে ফেসবুক। এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও দলটির গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার কথা বলেছিলো ফেসবুকের মূল কম্পানি মেটা। মেটার ২০২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়, সরিয়ে দেওয়া অ্যাকাউন্ট ও পেজগুলোর সম্মিলিতভাবে প্রায় ৩৪ লাখ ফলোয়ার ছিল। এসব পেজ থেকে ৬০ ডলার বিজ্ঞাপনী খরচ করা হয়। এরপর ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতিত সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে কিছু ভিডিও কনটেন্ট আপলোড করা হচ্ছে। খবরা-খবর পেতে এক পেস্টে নেতা-কর্মীদের ‘দলীয় সব খবর ও তথ্য পাঠাতে’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নম্বর দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের জন্য অনুরোধ করা হয়। ২৭ আগস্ট সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের নম্বর দিয়ে ‘আপডেট আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল খোলা হয়। সরকারের পতনের পর কয়েক দিন ফেসবুক ও এক্স হ্যান্ডলে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। একপর্যায়ে ফেসবুকে দেয়া বিভিন্ন পোস্ট নিয়েও বিতর্কে পড়ে আওয়ামী লীগ।
গত ২৪ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ ও ‘দেশরত্ন শেখ হাসিনা’ নামক দুটি ফেসবুক পেজ থেকে নরসিংদী জেলা ছাত্রদলের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান নাহিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা-ভিত্তিহীন পোস্টের মাধ্যমে অপপ্রচার করার অভিযোগ করে নরসিংদী জেলা ছাত্রদল। এর আগে ১০ ডিসেম্বর গণহত্যা এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাতে উস্কানির দেয়ায় আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড পেজ নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম প্রতিষ্ঠাতা ববি হাজ্জাজ। এছাড়াও ১৬ ডিসেম্বর সামাজিকমাধ্যমে কয়েকটি ছবি প্রচার করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে দাবি করা হয়– ছবিগুলো এ বছরের (২০২৪) বিজয় দিবস উদযাপনের সময়ে ধারণকৃত। তবে তথ্য তথ্যযাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার জানায়, ছবিগুলো ২০২২ সালের। একইভাবে গতবছরের আগষ্টে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগে ডিসমিসল্যাব প্রায় ১ হাজার ৩৬৯টি ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টের একটি নেটওয়ার্কের সন্ধানের খবর জানায়। তারা জানায়, “৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের পক্ষে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বিরোধী দলের ফেসবুক পোস্টে মন্তব্যের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ অপ্রপচার চালানো হয়েছে। আর এ কাজে বট (বিশেষ সফটওয়্যার) নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ।”
গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুক প্রোফাইলগুলো থেকে আওয়ামী লীগের পক্ষে ১৯৭টি পোস্টে সমন্বিতভাবে ২১ হাজারের বেশি মন্তব্য করা হয়েছে। তারা বিভিন্ন পোস্টে একই মন্তব্য করেছে। একই মন্তব্য বিভিন্ন প্রোফাইল থেকে পোস্ট করা হয়েছে। বট অ্যাকাউন্ট ও এর করা মন্তব্যের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ, এই গবেষণা করা হয়েছে মোট ১৯৭টি পোস্টে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে।