সুজাত আলী সোহান। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। ঘরে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত সন্তান। এর মধ্যে মরার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে আসে অতিমারি করোনা। প্রথম ধাক্কাতেই চাকরি হারান। ‘চোখে অন্ধকার দেখা’ সেই সময়ে লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রকল্পের ঝালকাঠি ৬১১ ব্যাচে ৫০ দিনের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ডিজিটাল মার্কেটিং শিখতে শিখতেই ফাইবার মার্কেটে প্লেসে দেড়শ’ ডলারের কাজ পেয়ে যান। দাঁত কামড়ে সেই কঠিন সময় পাড়িয়ে দিয়ে গত দেড় বছর ধরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার টার্নওভার করছেন এই সফল ফ্রিল্যান্সার। গড়ে তুলেছেন সার্ক অ্যান্টারপ্রাইজ। আগামী আট মাসে এক কোটি সেলের লক্ষ্য ছুঁড়ে দিয়েছেন নিজেকে।
সেই লক্ষ্য পূরণে রবিবার ঝালকাঠি স্মার্ট কর্মসংস্থান মেলায় চাকরিদাতা হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। তার মতোই করোনায় হতাশ হয়ে জীবন থেকেই ঝড়ে পড়ার অবস্থায় পৌঁছান যুথি আক্তার। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মাত্র ৫ ডলারের কাজ পেয়ে আরো হতাশ হয়ে ওঠেন যেন। ‘আমি পাড়বোনা; আমাকে দিয়ে হবে না’- নৈরাশ্যের পুরোনো ছকে ফিরতে শুরু করেন। কিন্তু মেন্টর প্রশিক্ষক শিশির মির্জার পরামর্শে এখন বুঝছেন ‘ধৈর্য্’র ফল সবসময় মিষ্টি হয়’। প্রতি মাসে ফাইবার থেকে ২১ হাজার ডলারের বেশি আয় করছেন এই লেভেল ২ সেলার।
সোহান ও যুথির মতো নয়; কর্মজীবনের শুরুতেই কম্পিউটার শিখতে গিয়ে প্রতারিত হন গালুয়া ইউনয়নের ডিজিটাল উদ্যোক্তা আব্দুল কাইয়্যুম খান। প্রশিক্ষণ নিয়েও দুই বছরে কিছুই করতে পারেননি। এনজিওতে চাকরি পেয়ে বেতন পাননি। এরপর নিজেই একটি কমপিউটারের দোকান দিয়ে মোবাইলে গান ডাউনলোডের কাজ শুরু করেন। এরপর ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে উদ্যোক্তা হিসেবে যোগ দেন। এখন তিনি মাসে নাগরিক ও বাণিজ্যিক সেবা দিয়ে মাসে ৭৫-৮০ হাজার টাকা আয় করছেন।
এমন আরো সফলতার গল্প বাস্তবে রূপ দিতে ঝালকাঠিতে শেখ রাসেল আইটি ইনকিউবেশন সেন্টার সেন্টার স্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে সঙ্গে নিয়ে জেলা শিল্পকলা একাডেমির মিলানায়তন থেকে সদর, নলসিটি, রাজাপুর ও কাঠালিয়া উপজেলায় ভার্চুয়ালি জয় ডিসেট সেন্টারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কিমিটির সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমু।
এরপর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। অশিক্ষিতদের স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুযোগ করতে সরকার ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার চালুর পাশাপাশি ৯০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সশরীর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। বলেছেন, ঝালকাঠীতে ৫৮০ জন নারী ফ্রিল্যান্সারকে প্রশিক্ষণসহ পুঁজি সহায়তা করা হবে। স্মার্ট নাগরিক গড়ে তুলতে এবছরই ১০ জেলায়; ২০২৫ সালের মধ্যে ৩০০টি এবং ২০৩১ সালের মধ্যে ৩৫ হাজার স্কুলে আফটার স্কুল প্রোগ্রাম কুমন এর মাধ্যমে ইংরেজিং, অংক এবং কমিউনিকেশন সফট স্কিল শেখানো হবে।
অনুষ্ঠানে ঝালকাঠীর ৩০ জনের মধ্যে ২২ জন নারী উদ্যোক্তাকে ৫০ হাজার টাকার একটি করে চেক তুলে দিয়ে পলক বলেন, এর মধ্যে যেই উদ্যোক্তারা সফল হবে প্রয়োজনে তাদের আরো ১০ লাখ টাকার অনুদান দেয়া হবে। এরপর স্মার্ট বাংলাদেশ লিমিটেড কোম্পানির মাধ্যমে ইক্যুইটি ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে ৫০ লাখ থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা হবে।
মেলার উদ্বোধনী বক্তব্যে জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, স্মার্ট কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে কর্মমুখী শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। দক্ষতা-যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে এ দেশের কেউ বেকার থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়ন হলে এদেশের প্রতিটি মানুষ দ্রুত সকল সেবা পাবেন। কোন রকম দুর্নীতি করার সুযোগ থাকবে না।
বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদক প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী পালনে উপস্থিত সবাইকে বঙ্গবন্ধুর ‘ভালোবাসা ও শান্তির দর্শন’ আত্মস্থ করে তা পালনের আহ্বান জানান আইসিটি প্রতিমন্ত্রী।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমু বলেন, আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমানে সকলকে এক যোগে কাজ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন এদেশে প্রতিটি নাগরিককে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা।
জেলা প্রশাসক ফারাহ্ গুল নিঝুমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন ব্র্যাক কুমন পরিচালনা প্রধান ওবায়েদ রহমান, আইসিটি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোঃ মোস্তাফা কামাল, ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন প্রকল্প পরিচালক প্রণব কুমার সাহা, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রকল্প পরিচালক ও অতিরিক্ত মহা পরিচালক এস.এ.এম রফিকুল নবী, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খান সাইফুল্লাহ পনির ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান খান আরিফুর রহমান।
ঝালকাঠীতে অনুষ্ঠিত স্মার্ট চাকরি মেলায় ২২টি বুথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ৫০০ জন কর্মী নিয়োগের জন্য দেড় হাজারের বেশি আবেদনকারীকে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকারে প্রার্থীর যোগ্যাতা ও দক্ষতার ঘাটতি মেটাতেও নেয়া হয় সেমিনার।
অনুষ্ঠান শেষে সদর উপজেলার কাশিপুর চহুতপুর মৌজায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টারের কার্যক্রম পরিদর্শন ও হাই-টেক পার্কের নির্মাণ কাজের অগ্রগতি এবং ঝালকাঠি সদর কৃষ্ণকাঠি মৌজায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের প্রস্তাবিত জায়গা পরিদর্শন করেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী।