মাত্র দুই দশক আগে ১৯৯০ সালে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) এর মাধ্যমে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তাদের সফটওয়্যার রফতানি শুরু করে। এরপর থেকে তাদের অধিকাংশই কম্পিউটার প্রোগ্রামিংসহ এ ধরণের সেবা রফতানিতে প্রসার ঘটিয়েছে, বলছিলেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর।
ডয়চে ভেলের বরাত দিয়ে তাইওয়ান নিউজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ১৯৯৭ সালে মাত্র ১৭টি কোম্পানি নিয়ে বেসিসের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে সংগঠনটির ১১৭০টির বেশি সদস্য কোম্পানি রয়েছে এবং তাদের অনেকেই বিশ্বব্যাপী সফটওয়্যার সেবা রফতানি করছে।
উদাহরণ হিসেবে, ডাটাসফট ১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব জামান ডয়চে ভেলেকে জানান, ১৯৯৬ সালে বিশ্বজুড়ে কম্পিউটারে ‘Y2K’ সিস্টেম বাগ ধরা পড়ে। বিষয়টি নিয়ে তখন ব্যবহারকারী ও ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। সেই সময়ে ভারতীয় আইটি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছে এই সমস্যার সমাধান রয়েছে বলে জানায়। তখন আমরা চিন্তা করি, যদি ভারত এই কাজ করতে পারে, তাহলে আমরা কোনো পারবো না?
২০০০ সালের প্রথম দিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুহাম্মদ জাফর ইকবালসহ মাহবুব জামান ভারতের আইটি রাজধানী হিসেবে পরিচিত ব্যাঙ্গালোরে যান। সেখানে দেশটির বিখ্যাত সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘ইনফোসিস’ এর কার্যালয় ঘুরে আসেন। তারপর দেশে এসে ডাটাসফট প্রতিষ্ঠা করেন। স্লোগান দেন- ‘আমরা সফটওয়্যার বানাই, আমরা কম্পিউটারকে অর্থবহ করে তুলি’।
মাহবুব জামান বলেন, তখন দেশে শুধুমাত্র বুয়েটেই কম্পিউটার সায়েন্স পড়ানো হতো। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যেতেন। তাই নিয়োগ দেয়ার জন্য বুয়েট থেকে পাশ করা কাউকে পাইনি। এরপর ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন করা শিক্ষার্থীদেরকে নিজ উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি।
বিদেশে রফতানি
বর্তমানে ডাটাসফট নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে আইটি সেবা রফতানি করে থাকে। তিন বছর আগে আফ্রিকার কঙ্গোতে আইওটি সেবা কার্যক্রম শুরু করে। সম্প্রতি জাপানের অন্যতম বৃহত্তম তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হিটাচি’র সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে ডাটাসফট। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেস রিকগনিশন সিস্টেম নিয়ে কাজ করছে। সৌদি আরবের মক্কা শহরের কেন্দ্রীয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণেও কাজ করছে ডাটাসফট।
পাশাপাশি, ২০১৬ সালের শেষের দিকে তাদের নির্মিত প্রথম অ্যান্টিভাইরাস বাজারে আনে আরেক বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান রিভ সিস্টেমস। ২০১৭ সালে দেশের বাজারে ছাড়ার পর গ্রাহকদের কাছ থেকে সন্তোষজনক ফলাফল আসে। এরপর ভারত এবং নেপালে অ্যান্টিভাইরাসটি রফতানি করা শুরু করে রিফ সিস্টেমস। বর্তমানে অনলাইনে ৫০টিরও বেশি দেশে গ্রাহক রয়েছে তাদের।
একই ধরণের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম টাইগার আইটি। নেপালের ভোটার নিবন্ধন সিস্টেমটি তারা তৈরি করেছে। এছাড়া ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমও তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ভারত এবং ভুটানের কিছু প্রকল্পেও কাজ করছে তারা। সম্প্রতি রাইড শেয়ারিং সেবা পাঠাও নামের বাংলাদেশি স্টার্টআপ নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডুতে তাদের সেবা সম্প্রসারণ করেছে।
পাঁচ বিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন
এটি কার্নির মার্কেট অ্যানালাইসিস টুলস গ্লোবাল লোকেশন সার্ভিস ইনডেস্কের সূত্র মতে, আইটি আউটসোর্সিং, বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে বিশ্বে বাংলাদেশের ২১ তম অবস্থানে রয়েছে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের সূত্র মতে, ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্য) এর তথ্যমতে, আউটসোর্সিং খাতে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ কাজ করছে, যাদের আয় বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীরের মতে, বর্তমানে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানই ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং ব্লকচেইনের মতো নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। এই খাতে আরও চাহিদা বাড়বে। ফলে এই চাহিদা পূরণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের বিষয়গুলোতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
বেসিসের সূত্র মতে, গত বছর তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশ প্রায় এক বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে এই আয় ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়। আলমাস কবীর মনে করেন, সরকার ফাইবার অপটিক ক্যাবলের কাজ শেষ করলে বাংলাদেশের গ্রামেও ইন্টারনেট সহজলভ্য হবে।
জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক এবং আফ্রিকার দেশগুলোসহ সম্ভাব্য বাজারগুলোতে ব্যবসা প্রসারের লক্ষে কাজ করছে বেসিস। কবীর বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা পেশ করেছি। আমরা জাপানে একটি বাংলাদেশ ডেস্ক তৈরি করতে চাই। সেখানে স্থানীয় মানুষদের নিয়োগের মাধ্যমে আমাদের কোম্পানিগুলোর প্রসারে কাজ করবো।
ডিবিটেক/বিএমটি