ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থান্নে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ২২টি প্রকল্পের ব্যয় ২৫ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর বেশিভাগই নেয়া হয়েছে ২০১৬ সালে। কয়েকটি প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে ২০২৭ সাল পর্যন্ত। চলমান প্রকল্পগুলোর কয়েকটির প্রকল্প বরাদ্দের টাকা বাড়ানো হয়েছে কয়েক ধাপে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে নানা ফরম্যাটে ডিজিটাল উপস্থাপনায় ব্যয় হয়েছে ৩৪ কোটি টাকারও বেশি। প্রকল্পগুলোর মধ্যে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার ছয়টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। এছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর তিনটি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৯৩৬ কোটি টাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়), ৫ হাজার ৯২৩ কোটি টাকার ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন (ইডিসি) প্রকল্প ও ২৮৭ কোটি টাকার হার পাওয়ার প্রকল্প : প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন-দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্প।
আলোচিত ছয় প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ২৭১ কোটি টাকার উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ প্রকল্প, ১৫৯ কোটি টাকার গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্প, ৫০৪ কোটি টাকার কানেকটেড বাংলাদেশ প্রকল্প, ২ হাজার ১৪১ কোটি টাকার বিজিডি ই-গভ. সার্ট প্রকল্প, ৪৭ কোটি টাকার সরকারের ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্ম শক্তিশালীকরণ প্রকল্প ও ২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকার ডিজিটাল সরকার ও অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ প্রকল্প (ইডিজিই)।
এভাবে সরকারি অর্থে ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তুলে তা পছন্দের লোকজনের মাধ্যমে দেখভালের দায়িত্ব পাইয়ে দিয়ে দেশের টাকার যথেচ্ছা ব্যবহার হওয়ার মাধ্যমে বেহাত হয়ে বিপুল অর্থ। অনালোচিত কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ প্রকলে।পর মধ্যে রয়েছে ৪৯ কোটি টাকার সরকারের ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফরম শক্তিশালীকরণ শীর্ষক প্রকল্প, ৮ কোটি টাকার পার্টনারশিপস ফর এ মোর টলারেন্ট, ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ (পিটিআইবি)।
প্রশ্নের মুখে থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের অধীনে ৮৩৭ কোটি টাকার শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার (১১টি) প্রকল্প (প্রথম সংশোধিত), ১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকার জেলা পর্যায়ে আইটি/হাই-টেক পার্ক স্থাপন (১২ জেলায়) (প্রথম সংশোধিত), ৫৩৩ কোটি টাকার শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্প, ৪৩১ কোটি টাকার বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি-২-এর সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প (দ্বিতীয় সংশোধিত), ৩৫৩ কোটি টাকার ডিজিটাল উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবন ইকো-সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্প, ৭৪ কোটি টাকার বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল সেবা ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ (বিডিসেট) কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাকরণ শীর্ষক প্রকল্প, ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকার শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি, ১ হাজার ১১৪ কোটি টাকার শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন (১৪টি) প্রকল্প।
একইভাবে ৮৫৫ কোটি টাকার অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই), ২৭ কোটি টাকার দীক্ষা-দক্ষতা উন্নয়নে শিক্ষা অনলাইনে, ৪৪২ কোটি টাকার উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ (তৃতীয় সংশোধিত), ১৫৮ কোটি টাকার গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধিকরণ (প্রথম সংশোধিত), ৩০ কোটি টাকার ডিজিটাল সিলেট সিটি শীর্ষক প্রকল্প (দ্বিতীয় সংশোধিত), ১৬৭ কোটি টাকার বিজিডি-ই-গভর্নমেন্টের সক্ষমতা বৃদ্ধি শীর্ষক প্রকল্পের তদন্ত চলমান রয়েছে।
এসব প্রকল্পের নামে চাতুরী আর লুটপাটে হাপিস হয়েছে বরাদ্দকৃত ২৫ হাজার কোটি টাকার অর্ধেক টাকা টাকার এই অংকটা নির্ধারণে চলছে তদন্ত ও লুটপাটের হিসাব নিকাশ। প্রকল্প প্রণয়ন থেকে বরাদ্দ, সময় ক্ষেপন, সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়ায় অর্থ ছাড় ইত্যাদি নানা কৌশলে তৎকালীর আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নেতৃত্বে একটি ক্লোজড সিন্ডিকেট প্রকল্পগুলো চালিয়েছে বলে জানতে পেরেছে তদন্ত কমিটি। তাই এগুলোমধ্যে চলমান ১০টির মতো ‘কুপ্রকল্প’ বাতিল করা হয়েছে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্ত কমিটি সূত্রে প্রকাশ, ‘প্রায় সব প্রকল্পের বাজেটে কতিপয় অঙ্কের ব্যাপারে বিস্মিত হতে হচ্ছে। এই ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অনুবিভাগ) মাহবুবুর রহমান। কমিটিতে সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন আইসিটি বিভাগের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অনুবিভাগের আইন শাখার উপসচিব মোঃ সিদ্দিকুর রহমান তালুকদার। কমিটিতে অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি, এটুআই প্রকল্প পরিচালক মো: মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের উন্নয়ন ও পরিকল্পনা শাখার মনিরুল ইসলাম এবং বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি), সরকারি কেনাকাটা মূল্যায়নের গঠিত সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) একজন করে প্রতিনিধিও রয়েছেন।
চলমান তদন্ত নিয়ে প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, তদন্তে ২১ জন পিডিকে তলব করা হয়েছিল। তাদের বক্তব্য পর্যালোচনায় প্রায় প্রতিটি প্রকল্পে নানা ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের আলামত মিলেছে। ফলে তদন্তের সময়ই চলমান বেশির ভাগ প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় টাকার অঙ্ক বাদ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেছেন, তদন্তে দুর্নীতির থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে। চলমান প্রকল্পের বাইরে হাতে নেওয়া হয়েছে এমন বেশ কয়েকটি ভবিষ্যৎ প্রকল্পেরও তদন্ত করা হচ্ছে। সেসব প্রকল্পেও হরিলুটের চিত্র পাচ্ছি। এরই মধ্যে ১০-১২টি প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা সূত্রে প্রকাশ, তদন্ত কমিটির কাছে তারা জবাবদিহি করছেন। কমিটির পক্ষ থেকে কোনো কোনো প্রকল্পের বাজেট কাটছাঁট করার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্পের কেনাকাটা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলছেন। পাশাপাশি যাদের বিভিন্ন কাজ দেওয়া হয়েছে তাদের বিষয়েও বিশদ খোঁজখবর নিচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানকে ডিজিটাল মাধ্যমে উপস্থাপনে ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ, চ্যাটবট, হলোগ্রাফিক প্রজেকশন, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির (ভিআর) মতো প্ল্যাটফর্মের নামে বিপুল অর্থ খরচ করা হয়েছে। আবার এসব কাজও দেয়া হয়েছে শেখ পরিবার এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ঘনিষ্ঠজনদের। বিপুল অর্থ খরচের এসব প্রকল্পের বিপরীতে নিম্নমানের কাজ জমা দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে।
আলোচিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে “মোবাইল গেইম ও এ্যাপ্লিকেশন এর দক্ষতা উন্নয়ন শীর্ষক” প্রকল্প গৃহীত হয়। ৩৩০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল মোবাইল গেম এবং স্মার্টফোনভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন তথা অ্যাপ তৈরিতে দেশজুড়ে দক্ষ জনবল তৈরি করা। প্রকল্পটির আগামী ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। অবশ্য প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজের বিশ্লেষণে প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের চেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আর তার স্বজনদের নিয়েই নানান কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পেরেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তারা দেখেছেন, প্রকল্পের ১০ শতাংশের বেশিই খরচ হয়েছে শেখ মুজিব এবং শেখ রাসেলের শ্রাদ্ধে।
প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ সম্পর্কিত এক নথি অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের জন্য ‘মুজিব জিজ্ঞাসা’ নামক একটি চ্যাটবট বানিয়েছে প্রকল্প কার্যালয়। এই ট্রাস্টের চেয়ারপারসন ছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু কন্যা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২২ সালের নভেম্বরে এই চ্যাটবট তৈরির কাজ দেওয়া হয় ‘হেডলেস টেকনোলিজ লিমিটেড’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে। প্রকল্প নথি বলছে, কাজটি সম্পূর্ণ হয়েছে এবং ট্রাস্টকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘মুজিব জিজ্ঞাসা’ ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ব্যবহারকারীর প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে একটি ‘ইন্টারএকটিভ চ্যাটবক্স’ রয়েছে।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, চ্যাটজিপিটি’র মত যেকোন কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সম্পন্ন চ্যাটিং প্ল্যাটফর্মেই এধরনের কাজ সম্ভব। ওয়েবসাইটটিতে দেওয়া গুগল প্লে-স্টোর অ্যাপে গিয়ে দেখা যায়, অদ্যবধি মাত্র পাঁচ শতাধিকের কিছু বেশিবার অ্যাপটি ডাউনলোড হয়েছে। আর এতেই চ্যাটবটটির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৭১ লাখ টাকা।
একই ট্রাস্টের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু অভিধান’ নামে আরেকটি ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি হয়েছে এই প্রকল্পের টাকায়। ৭৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয়ের এই কাজটি পেয়েছে ‘প্রাইম টেক সলিশনস লিমিটেড’। ২০২৩ সালের মে’তে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর কাজটি ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে এই অভিধান কোথায় কী কাজে কোথায় ব্যবহৃত হচ্ছে সেটি অনুসন্ধানে পাওয়া যায়নি। শেখ মুজিবের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনে ‘মুজিব ১০০ ডট গভ ডট বিডি’
ওয়েবসাইটের বিপরীতে মোবাইল অ্যাপ তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ৩৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। কাজটি করেছে ‘ইজি টেকনোলজি লিমিটেড’। ট্রাস্টের জন্য ‘রাসেল সোনা’ নামে একটি ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন চলচিত্রও তৈরি করা হয়েছে এই প্রকল্পের টাকায়। ২ কোটি ৯৮ লাখ টাকারও বেশি ব্যয়ে চলচিত্রটি বানানোর কাজ যৌথভাবে পেয়েছে ‘স্কেচ স্টুডিও লিমিটেড’ এবং ‘স্পিনঅফ স্টুডিও’।
স্পিনঅফের প্রধান নির্বাহী এএসএম আসাদুজ্জামান পলকের খুব ঘনিষ্ঠজন হিসেবে আইসিটি বিভাগে পরিচিত। মাত্র ২৩ মিনিট দৈর্ঘ্যরে এ অ্যানিমেশন ফিল্মটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি মিনিটে খরচ ১৩ লাখ টাকা। শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের জন্য আরও একটি অ্যানিমেশন চলচিত্র তৈরি করেছে আইসিটি বিভাগের এই প্রকল্প।
শেখ হাসিনার লেখা ‘মুজিব আমার পিতা’ বই অবলম্বনে ‘মুজিব আমার পিতা’ অ্যানিমেশন চলচিত্রটি মুক্তি পায় ২০২১ সালের ১ অক্টোবর। ৪০ মিনিট দৈর্ঘ্যের চলচিত্রটির জন্য মোট ব্যয় হয় ৩ কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অর্থ্যাত প্রতি মিনিটের জন্য ব্যয় প্রায় ৮০ হাজার টাকা। কাজটির দরপত্র পেয়েছিল ‘বিএমআইটি সলিউশনস লিমিটেড’। তবে জানা যায়, এর অ্যানিমেশন তৈরিতে কাজ করেছে প্রোলান্সার স্টুডিও। সরকারি খরচে যুক্তরাষ্ট্রে সিনেমাটির বিশ্ব প্রিমিয়ার করে আইসিটি বিভাগ।
এ সিনেমার গবেষণা সমন্বয়ক ছিলেন আওয়ামী লীগের (এএলবিডি) ওয়েব টিমের সমন্বয়কারী তন্ময় আহমেদ। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প থেকে বিপুল অর্থায়নে নির্মিত আরেকটি অ্যানিমেশন সিরিজ ‘খোকা’। ৯৩ মিনিটের এ অ্যানিমেশন তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ১১ পর্বের এ অ্যানিমেশন সিরিজের পরিচালনায়ও ছিলেন প্রোলান্সার স্টুডিওর সোহেল মোহাম্মদ রানা। ২০২৩ সালের ২৩ জুন মুক্তি পায় ৪৩ মিনিট ১৩ সেকেন্ডের আরেক অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ‘মুজিব ভাই’। ৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয়ের এই চলচিত্রটি নির্মাণের কাজ পায় টেকনোম্যাজিক প্রাইভেট লিমিটেড। সহযোগী ছিল হাইপার ট্যাগ লিমিটেড। এই গবেষণার নেতৃত্বেও ছিলেন তন্ময় আহমেদ। পরিচালনা করেছেন সোহেল মোহাম্মদ রানা। নির্বাহী প্রযোজক ছিলেন জিনাত ফারজানা, আরিফ মোহাম্মদ ও মো. শফিউল আলম। ‘
‘মুজিব ভাই’ অ্যানিমেশনের পেছনে প্রতি মিনিটে খরচ হয়েছে সাড়ে ১১ লাখ টাকা। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের মুজিব জাদুঘরে এবং রাজশাহী হাইটেক পার্কে ৭ মার্চে শেখ মজিবুর রহমানের ভাষণকে কেন্দ্র করে হলোগ্রাফিক প্রজেকশন এবং থিয়েটারও তৈরি করা হয়েছে এই প্রকল্পের টাকায়। লেজার রশ্মীতে শেখ মুজিবের অবয়ব এবং ‘ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক’ এর মাধ্যমে ৭ মার্চের আবহ তৈরির কাজটিতে ব্যয় হয়েছে ২০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। সর্বোচ্চ অর্থায়নের এই কাজটি পেয়েছে এনডিই সলিউশন। তবে এধরনের কাজ সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও শুধু শেখ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে কাজটি এনডিই’কে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
প্রকল্পের অর্থায়নে শেখ মুজিবের ডিজিটাল সংস্করণে এতো অর্থ খরচের ব্যাখ্যায় প্রকল্পটির বর্তমান পরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, প্রকল্প কার্যালয় থেকে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী ডিজিটাল রিসোর্স তৈরি করে দেওয়া হতো। তবে শেখ মুজিব সম্পর্কিত এসব কাজের দরপত্র তার দায়িত্ব গ্রহণের আগে দেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পের একদম শেষের দিকে তিনি পরিচালক নিযুক্ত হন। ফলে প্রকল্প সমাপ্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করাই তার মূল দায়িত্ব হয়ে ওঠে। তাই তার আগে যারা প্রকল্প পরিচালক হিসেবে এসব কাজ দিয়েছেন তারা এগুলো সম্পর্কে ভালো বলতে পারবেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শেখ মুজিব সম্পর্কিত বেশিরভাগ কাজগুলোর দরপত্র দেওয়া হয়েছে সাবেক প্রকল্প পরিচালক আনোয়ারুল ইসলামের সময়ে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এই কাজগুলো সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের পলকের নির্দেশনায় অগ্রাধিকভার ভিত্তিতে করা হয়েছিল। তবে সবকিছুই আইসিটি বিভাগের অনুমোদনে হয়েছিল।
তবে এধরনের কাজ আইসিটি বিভাগের আওতা এবং উদ্দেশ্যের মধ্যে পড়ে না বলে মনে করছেন আইসিটি খাত সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘস্থায়িত্ব নেই অথবা আইসিটি খাতে অবদান রাখে না এমন কর্মকাণ্ডে এধরনের অর্থ খরচের বিরোধিতাও করছেন তারা।
আইসিটি খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর এবং ফাহিম মাশরুর উভয়েই মনে করেন, কাজগুলো আইসিটি বিভাগের কাজের মধ্যে পড়ে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন। কেননা কাজগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় করতে পারতো। তাছাড়া এসব কাজের সাথে আইসিটি বিভাগের যে উদ্দেশ্য দেশকে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত করা, আইসিটি খাতে কর্মসংস্থান এবং দক্ষ জনগল তৈরি করা; সেসব উদ্দেশ্যের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পাশাপাশি এগুলোর কোন দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই অবদান নেই। কাজেই এধরনের কাজে রাষ্ট্র ও জনগণের অর্থ ব্যয়ের আগে খতিয়ে দেখা উচিত ছিলো।