দীপ্তির পিতৃপরিবারের ৪ জনই মুক্তিযোদ্ধা
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উত্তাল দেশে ‘টকশো’ সঞ্চালনায় বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে ভাইরাল হয়েছিলেন উপস্থাপিকা দীপ্তি চৌধুরী। নিজ গুণেই ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানে শহরের দেয়ালে আঁকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গ্রাফিতিতেও স্থান পায় তার মুখ।
নাটকীয় ভাবে সেই গ্রাফিতিতে চুনকালি দিয়ে মুছে দেয়ার মতো দেশজুড়ে সামাজিকমাধ্যমে প্রশংসায় মুখর হওয়া এই নারীকে নিয়ে হঠাৎ করে শুরু হয়েছে নেতিবাচক আক্রমণ। আলোচনায় ফের আলোচিত ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ট্যাগ। ‘মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য প্রসঙ্গে দীপ্তি চৌধুরী’ আমার নানীর ফুফাতো বোনের স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন’ শীর্ষক শিরোনামে জাতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের ডিজাইন সম্বলিত একটি ফটোকার্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়ানো হয় হঠাৎই। দীপ্তি চৌধুরীর ছবিযুক্ত ফটোকার্ডটিতে লেখা, আমার নানীর ফুফাতো বোনের স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তবে কথিত ফটোকার্ডটির কোনো সত্যতা নেই বলে গণমাধ্যমটির পেইজ থেকে পোস্ট করা হয়েছে।
অবশ্য অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নিঝুম মজুমদার তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে শুক্রবার (২২ নভেম্বর) দীপ্তি চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে লেখেন, দীপ্তি চৌধুরী, আপনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান বলেছেন। আপনার পরিবারের কে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন? কোন সেক্টরে? নাম কী? আপনার সঙ্গে সম্পর্ক কী? সহজ বিষয়। এই সহজ উত্তর দিতে আপনার দেরি হচ্ছে কেন?
এছাড়ও ২০২৪ সালের এইচ এস সি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে কিছু কিছু অনলাইন পেজ থেকে দীপ্তি চৌধুরী এইচ এস সি পরীক্ষায় ফেইল করেছেন এমন ভূয়া তথ্য ছড়ানো হয়। কেউ ‘ফান’ করে আবার কেউ বিভ্রান্ত হয়ে এই মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখে। অথচ তিনি ২০২১ সালে এইচ এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আর এখন তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।
এভাবেই চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি এ নিয়ে দীপ্তিকে কটাক্ষ করে ছড়ানো শুরু হয় বহু গুজবে খবর! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দীপ্তি চৌধুরীকে ট্রলিং-এর মাধ্যমে বুলিং করা শুরু হয়। এমন পরিস্থিতিতে ফ্যাক্টচেকার প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যান বিষয়টি কুপ্রচারণা বলে প্রমাণ করে। একইভাবে পুরো বিষয়টি বিশদ অনুসন্ধান করে ডিজিবাংলাটেক। অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়া ঘেঁটে ফ্যাক্ট চেক আর অনুসন্ধানে আরো দীপ্তময় হয়ে উঠে দীপ্তি চৌধুরীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সংশ্লিষ্টতা। কেননা তিনি শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধার নাতনিই নন, তার পরিবারে রয়েছে আরো ৩জন মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধা ইস্যু নিয়ে তথ্য বিকৃতি ও মিথ্যাচার:
দীপ্তি চৌধুরীকে টেলিভিশনের পর্দায় অপমান করে বিচারপতি মানিক লিখিতভাবে ক্ষমা চাইলেও ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে অনলাইন কমিউনিটি-তে কিছু ব্যক্তি ও প্লাটফর্ম দীপ্তি চৌধুরীকে নানানভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। সেখানে নানান তথ্যবিকৃতি করা হয়। ইউটিউবে সকল প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যে মিথ্যাচার সবচেয়ে বেশি সামনে এসেছে তা হলো- দীপ্তি চৌধুরী নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার ‘সন্তান’ দাবি করেছেন।
বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, দীপ্তি চৌধুরী কোথাও বলেন নি তার বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। এটি সম্ভবও নয়। কারণ দীপ্তি চৌধুরীর বাবার জন্মসাল ১৯৭২। আসলে দীপ্তি চৌধুরী নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা ‘পরিবারের সন্তান’ বলেছেন। দীপ্তি চৌধুরী দাবি না করলেও ফেসবুকে তথ্য বিকৃত করে নানানভাবে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে একটি মহল। সেখানে কিছু চিহ্নিত এক্টিভিস্টরাও স্রোতে গা ভাসিয়ে এই অপপ্রচারে অংশ হয়েছেন। এমনকি কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী ইভেন্ট ক্রিয়েট করে জানতে চেয়েছেন দীপ্তি চৌধুরীর মুক্তিযোদ্ধা পিতার পরিচয়।
মুক্তিযুদ্ধে দীপ্তি চৌধুরী-র পরিবারের তৎকালীণ সদস্যদের ভূমিকা:
দীপ্তি চৌধুরী বলেছেন তিনি ‘মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের’ সন্তান। এ কথাটির অর্থ কী? এ কথার একটাই অর্থ। দীপ্তি চৌধুরী বুঝাতে চেয়েছেন তার পরিবারের কেউ না কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তাই তিনি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান।
আবারো মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে- টু দ্য পয়েন্ট টক শো-তে যে ভিডিও টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিলো (https://www.youtube.com/watch?v=h6YXLnyG7-A ।) সেখানে দীপ্তি চৌধুরী কোথাও বলেন নি তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেছেন- আমি ‘মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের’ সন্তান।
ঘটনার কিছুদিন পরেই দ্য আরজে কিবরিয়া শো তে গিয়ে দীপ্তি চৌধুরী বিষয়টি স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছিলেন, তার বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেননি। তিনি বলেছিলেন, তার দাদা এবং সেই প্রজন্মের পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানটির (১৩.১- ১৪.১৭) অংশে এই বক্তব্য পাওয়া যাবে-
সুতরাং অনসদ্ধান করে যদি জানা যায় যে, তার দাদা এবং অন্য সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাহলে বিষয়টি নিয়ে অনলাইনে যে তথ্যবিকৃতি চলছে তার সুরাহা হবে।
দেখা যাক- এ বিষয়ে কী তথ্য পাওয়া যায়। দীপ্তি চৌধুরীর জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলায়, তবে তার দাদার বাড়ি ও বাবার জন্মস্থান কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম থানার আদমপুর ইউনিয়নে। তার দাদা নুরুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন আদমপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। (মুক্তিযুদ্ধের কিছু কাগজ পত্রে তাকে নুর ইছলাম চৌধুরি হিসেবে লেখা হয়েছে, তার বাবার নাম আবদুল হামিদ চৌধুরি)। ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি একজন প্রসিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তার অস্ত্র জমা দেওয়ার দলিলটি এখানে দেওয়া হলো।
অষ্টগ্রামের স্থানীয় মানুষ এবং জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে দীপ্তি চৌধুরীর দাদা মরহুম নুরুল ইসলাম চৌধুরী সম্বন্ধে জানা যাবে। দেশাত্মবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে বিষয়ক নিজস্ব ধারণা থেকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন সুবিধা গ্রহণ করেন নি এবং সার্টিফিকেটও গ্রহণ করেন নি (যা স্থানীয় চেয়ারম্যান তার স্মৃতিচারণে নিশ্চিত করেছেন)। এ বিষয়ে একটি ভিডিও ডকুমেন্ট এখানে পাওয়া যাবে-
https://vimeo.com/1032582527/ce7ede446d
যৌথ পরিবারে দীপ্তি চৌধুরীর দাদারা ১৪ ভাই (আপন+চাচাতো) ছিলেন। এদের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন ৪ জন। আরেকজন বর্ডার ক্রস করে ট্রেনিং এ গেলে বয়স কম থাকায় তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। দীপ্তি চৌধুরির চাচাতো দাদা জনাব জয়নুল আবেদীন চৌধুরী (যার পিতা জনাব আবদুল হামিদ চৌধুরী) বর্তমানে কানাডা প্রবাসী। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। বর্ডার পেড়িয়ে ভারতে ট্রেনিং নিয়ে তিনি ওয়ারলেস অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ.জি ওসমানির কাছ থেকে সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত।
অষ্টগ্রামে দীপ্তি চৌধুরীর দাদা মুক্তিযোদ্ধা জনাব নুরুল ইসলাম চৌধুরী ও তার ভাই-দের গৌরবময় ভূমিকা সুবিদিত। জনাব নুরুল ইসলাম চৌধুরীর মুক্তিযোদ্ধা চাচাতো ভাইয়েরা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সনদ নিয়েছেন। তারাও দিপ্তী চৌধুরীর দাদা হন।
এই তথ্য-উপাত্তে প্রমাণিত হচ্ছে দীপ্তি চৌধুরী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধার নাতনি। তার পিতা শিবলী চৌধুরির বেড়ে ওঠা কর্মসূত্রে ব্রক্ষ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগরে বাস করলেও, তার বর্ধিত পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ অষ্টগ্রামে এখনো বাস করছেন। এই সম্মানে আঘাত করায় মানসিকভাবে আহত হয়েছেন দীপ্তি চৌধুরী। সেই দুঃখগাঁথাই যেনো সাবলীল ভাষায় তুলে ধরেছেন তিনি নিজের ফেসবুক পেজে। লিখেছেন, “বডি শেমিং, ট্রলিং, পলিটিকাল হ্যারেসমেন্ট আরও কত কিছু! একটার পর একটা। ক্লান্ত লাগে না আপনাদের? একবারও বুক কাঁপে না শুধুমাত্র রাজনৈতিক জেদ থেকে এমন মিথ্যাচার করতে? সত্যি জানার জন্য হয়তোবা অপেক্ষা করতে হবে।”
দীপ্তির ভাষ্য, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেইক নিউজের ছড়াছড়ি। সত্যের পক্ষে থেকে যার যার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করা উচিত। খারাপ মানুষরা ঐক্যবদ্ধ। তারা খারাপ বিষয়গুলো দ্রুত ছড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু ভালো মানুষের ঐক্যবদ্ধতা তুলনামূলক কম থাকায় আওয়াজ তুলতে দেরি হয়। অনলাইনে যে হ্যারেজমেন্ট শুরু হয়েছে সচেতন নাগরিকদের সকলের আওয়াজ তোলা উচিত। এক্ষেত্রে মিডিয়া সত্যের পক্ষে থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।”