হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সুস্পষ্ট হওয়ার আগেই কামড় বসাতে শুরু করেছে মার্কিন কোম্পানিগুলো। এর একদিন বাদেই সোমবার চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিপ সরবরাহকারী মার্কিন সংস্থাগুলোর স্টক মূল্য হ্রাস পেয়েছে। গুগল এর জনপ্রিয় সফ্টওয়্যার এবং পরিষেবাদি হারিয়ে স্মার্টফোন বিক্রিতে প্রত্যাশিত ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে হুয়াওয়ে।
এই পদক্ষেপটি বেইজিংয়ের সাথে বাণিজ্য-যুদ্ধের উত্তেজনা বাড়িয়েছে। একইসঙ্গে সময়ের সাথে সাথে বাড়িয়েছে চীনকে আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ঝুঁকি।
বিরোধ
গত সপ্তাহে তথাকথিত এন্টিটি তালিকায় হুয়াওয়েকে অন্তর্ভূক্ত করেছে মার্কিন বাণিজ্য বিভাগ। এর ফলে সরকারী অনুমোদন ছাড়া হুয়াওয়ে’র কাছে কোনো প্রযুক্তির বিক্রি করতে পারবে না মার্কিন সংস্থা।
এরপর এক বিবৃতিতে গুগল জানায়, ভবিষ্যতের হুয়াওয়ে ডিভাইসগুলিতে মানচিত্র, জিমেইল এবং অনুসন্ধান সহ তার ফ্ল্যাগশিপ অ্যাপ্লিকেশন এবং পরিষেবা দেবে না। শুধুমাত্র মৌলিক পরিষেবা পাওয়া যাবে। তবে সেবাগুলো বিদ্যমান হুয়াওয়ে স্মার্টফোনগুলিকে সমর্থন করবে।
অন্যদিকে নেটওয়ার্কিং সরঞ্জামাদি সরবরাহকারী হিসেবে বিশ্বে নেতৃস্থানীয় হুয়াওয়ে। তবে কম্পিউটার চিপ সহ কিছু কমপোনেন্টের জন্য মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তাদেরকে নির্ভর করতে হয়। হুয়াওয়ের সরবরাহকারীদের এক তৃতীয়াংশই প্রায় আমেরিকান।
কেন এই শাস্তি?
শক্ত কোনো প্রমাল ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরেই নিপীড়ক বেইজিং শাসকের এজেন্ট হিসেবে হুয়াওয়ায়েকে ‘অবিশ্বাসযোগ্য’ বলে বিবেচনা করে আসছে মার্কিন প্রতিরক্ষা এবং গোয়েন্দা সংস্থা। পরবর্তী প্রজন্মের ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক বিস্তারের ক্ষেত্রে হুয়াওয়ে ‘র সরঞ্জাম ব্যবহারে ইউরোপে মিত্রদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন বলছে, ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি এবং হুয়াইয়ের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রশ্নবিদ্ধ হলেও এটি জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু। কিন্তু পশ্চাদপসরণ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত কর্তৃত্বের জন্য সংগ্রাম।
ক্রমবর্ধমান শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য যুদ্ধের রাজনীতিতে রাষ্ট্র সমর্থিত চীনা কোম্পানি সাইবার চুরি এবং সামরিক গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে ঝোপ বুঝে কোপ মারবে শঙ্কা ব্যক্ত করে দীর্ঘমেয়াদী নীতির লক্ষ্য তুলে ধরেছেন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। বণিজ্য সচিব উলবার রস গত সম্পাহে বলেছেন, হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাণিজ্য যুদ্ধের কিছু নয়। হুয়াওয়ের আচরণ বদলালেই এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হতে পারে।
বিশ্লেষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যদি হুয়াওয়ে কেবল অ্যান্ড্রয়েডের একটি স্ট্রিপড-ডাউন সংস্করণ ব্যবহার করতে পারে তবে ব্যবহারকারীরা হুয়াওয়েকে ত্যাগ করবে। বর্তমানে স্মার্টফোন বাজারে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা হুয়াওয়ে অ্যাপলে’র পেছনে পড়ে তৃতীয় অবস্থানে চলে যাবে। এক্ষেত্রে গুগল ছাড় চাইতে পারে। কিন্তু এটি করার পরিকল্পনা আসে কি না তা নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি নন প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্ররা।
তারপরও কারা হুয়াওয়ে ব্যবহার করেন?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ ভোক্তাই হুয়াওয়ে’র নামটি সঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে পারেন না। তারা বলেন- ‘হ-ওয়ে ‘। তবে বিশ্বের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্র্যান্ডটি সুপরিচিত। সেখানে লোকেরা দলে দলে স্মার্টফোন কিনেছেন। নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সহজলভ্য এবং অভিজাত মডেলের লাইনআপ নিয়ে ইতিমধ্যিই স্মার্টফোন বাজারে তারকা খ্যাতি অর্জন করে নিয়েছে হুওয়ায়ে। গার্টনার বিশ্লেষক অ্যানেটি জিমারম্যানের হিসাবে, চীন এবং ইউরোপে উচ্চবিত্তরাও এই মডেলের দিকে ঝুঁকছেন। উৎপাদিত স্মার্টফোনের প্রায় ১৩ শতাংশই ইউরোপের বাজারে বিক্রি হচ্ছে ইউরোপে। সব মিলিয়ে, কৌশলগত পরিকল্পনায় এগিয়ে থেকে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে বাজারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিক্রেতার তকমা অর্জন করেছে হুয়াওয়ে। আইডিসি’র হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত সময়ে হুয়াওয়ে ৫৯ মিলিয়ন স্মার্টফোন শিপমেন্ট করেছে। অ্যাপল করেছে ২৩ মিলিয়ন।
তীব্র প্রভাব
নিষেধাজ্ঞাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবাঞ্ছিত প্রভাব ফেলতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে হুয়াওয়ে কতটি প্রযুক্তি কিনেছে এর উত্তর থেকে তা সহজে অনুমেয়। বিশেষ করে স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট নেটওয়ার্কিং গিয়ার এবং অন্যান্য গ্যাজেটে চলে এমন মাইক্রোপ্রসেসর প্রস্তুতকারকদের থেকে কতটি প্রযুক্তি কেনে হুয়াওয়ে ।
চিপ কোম্পানিগুলির তালিকা অনুযায়ী মাইক্রন টেকনোলজিস, কোয়ালকম, কোভার এবং স্কাইওয়ার্কস সলিউশনস হুয়াওয়েয়ের একটি প্রধান গ্রাহক হিসাবে তালিকাভুক্ত রয়েছে। শিল্প বিশ্লেষকগণের মতে, অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছে জিলিং, ব্রডকোম এবং টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্টস।
হুয়াওয়েকে চিপ সরবরাহ বন্ধের ঘোষণার পর ইতিমধ্যেই পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়া শুরু হয়েছে। ট্রাম প্রশাসনের চীনা পণ্যে ক্রমবর্ধমান শুল্ক নীতি বুমেরাং হতে চলেছে।
সোমবার দেশটির বাণিজ্য বিভাগ প্রত্যাশিত ভাবেই ঘোষণা দিয়েছে ৯০ দিনের বা তার বেশি সময়ের প্রযুক্তি সেবা বিক্রিতে সরবরাহকারীদের সতর্ক করে। এই নিষেধাজ্ঞা আরো বাড়তে পারে। ফ্রান্স, জার্মানি, ইউ কে এবং নেদারল্যান্ডস সহ দেশগুলি তাদের বেতার নেটওয়ার্কগুলি থেকে হুয়াওয়ে সরঞ্জামগুলিকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিতে অস্বীকারের অপর বিষয়টি নির্ভর করছে।
গ্রেস সময়ে মার্কিন সরবরাহকারীদের নিরাপত্তা দুর্বলতার জন্য হুয়াওয়েকে সতর্ক করে দেয় এবং পরবর্তী প্রজন্মের ৫জি বেতার তরঙ্গ নেটওয়ার্কের জন্য চীনা কোম্পানিটিকে গবেষণার সাথে যুক্ত করে। ইউএস অপারটেররা গ্রামীণ ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কে হুয়াওয়ে রাউটারের ব্যবহার থেকে সরে আসতে সময় বেধে দেয়।
ডিগবাজি নয় তো?
ইতিমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম সরবারহকারীর আসনে আসীন হয়েছে হুয়াওয়ে। বর্তমানে প্রায় সকল সরঞ্জামই নিজেদের ঘরেই তৈরি করছে। ২০২৫ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তিতে স্বনির্ভর হতে নীতি গ্রহণ করেছে চীন।
অন্যদিকে বিক্রি পড়ে যাওয়ায় মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মন্দাবস্থা দেখা দিতে পারে। এর প্রবাহে কোম্পানিই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কম্পিউটিং টেকনোলজির ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (কম্পটিআ) মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তিখাতের ৫২ হাজারেরও বেশি চাকরি সরাসরি চীনের রপ্তানির সাথে যুক্ত।
গুগলের ক্ষতি কি?
হুয়াওয়ে ফোনে বিজ্ঞাপন দেখিয়ে লাইসেন্সিং ফি পায় গুগল। এই নিষেধজ্ঞায় গুগলের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট ইনক আর্থিক চাপে পড়তে পারে। কেননা চলতি বছরে হুয়াওয়ে থেকে ১৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের যে প্রাক্কলিত লক্ষ্য ধরা হয়েছিলো তা হাতছাড়া হবে।
অ্যাপলের ওপর প্রভাব
হুয়াওয়ের নিষেধাজ্ঞায় স্যামসাং এবং অ্যাপলের বাজারেও প্রভাব পড়বে। যদিও উভয় কোম্পানিই তাদের বৈশ্বিক স্মার্টফোন বাজার টেনে তুলতে চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে অ্যাপল। কেননা চীনেই অ্যাপলের সবেচেয়ে বেশি আইফোন অ্যাসেম্বেল হয়ে থাকে। যদি চীনা সরকার অ্যাপলকে চীনে ব্লক করে তবে তাদের সাপ্লাইচেন ভেঙ্গে পড়বে। এক্ষেত্রে বাজারে টিকে থাকতে হয় ফোনের দাম বাড়াতে হবে, নয়তো মুনাফা কাটতে হবে।