প্রায় এক দশক ধরে সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতায় ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কাজ করে আসছে সিটিও ফোরাম বাংলাদেশ। এই ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট তপন কান্তি সরকার। আর্থিক খাতের ডিজিটাল রূপান্তর ও সুরক্ষায় কাজ করছেন এনসিসি ব্যাংকের সাবেক এই প্রধান তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকর্তা। কাজের ব্যাপ্তি বাড়াতে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফট্ওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস), এটুআই, তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ, বিডিসিইআরটি, আইএসপিএবি, বিজেআইটি, দোহাটেক, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করা আরও কিছু প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠান করেন ‘ইনফরমেশন সিকিউরিটি অ্যালায়েন্স’ নামের একটি জোট। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ অর্জন করেছেন তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাড়ের শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি কর্মকর্তা পুরস্কার ‘বেস্ট সিটিও ২০১৪’; ব্যাংকিং সেক্টরের সফল আইটি ব্যাক্তিত্ব-২০১৫ সম্মাননাসহ নানা পুরস্কার। বর্তমানে সাইবার সিকিউরিটির উপর CISA USA chapter এর সাথে তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন। সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতা মূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।একান্ত সাক্ষাৎকারে ডিজিবাংলা-কে জানালেন এই খাতের সম্ভানা, চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি বিষয়ে।
কেমন গেল ২০১৯ ?
নানা সম্ভাবনা ও ঝুকির বছর ছিলো ২০১৯। সারা বিশ্বেই রাজনৈতিক ডামাডোলের মাঝে সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের আগমনী বছর হিসেবে ধরা হচ্ছিলো এই ২০১৯ কে। সেই দিক থেকে বলবো বড় কোনো অঘটন ছাড়াই শুধু চোখ রঙ্গিয়ে বছরটি সমাপ্ত হয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ডিজিটাল রূপান্তরের ঝুঁকিগেুলো কি যথাযথ ভাবে মোকাবেলা করা হয়েছে?
শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো বিশ্বই ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। নিত্য নতুন প্রযুক্তির প্রভাব পড়ছে ব্যবসা বাণিজ্যে। নতুন প্রযুক্তির ফলে এর সম্ভাবনাও নতুন সেই সাথে এর ঝুঁকি গুলোও নতুন। অনেক সময় দেখা যায়, ঝুঁকি গুলো বুঝতে ও এর মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সঠিক ধারণা থাকে না। তবে আমি বলব এখন পর্যন্ত যতগুলো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে তার কিছু বাদে বাকি সব গুলোকেই ভালোভাবে মোকাবেলা করা গেছে।
আমাদের দেশের সিটিও-দের চাকরির বাজার কী পরিমাণ বেড়েছে? চলতি বছরে কতটা বাড়বে?
ডিজিটাল বাংলাদেশ রুপান্তরের কারিগরই হচ্ছে দেশের সিটিও গণ। দেশে নতুন নতুন সম্ভাবনা যেমন বাড়ছে সেই সাথে বাড়ছে প্রযুক্তি ভিত্তিক ব্যাবসা ও সেবা। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, দেশে সিটিওদের চাকরির বাজার অনেক বেড়েছে, এবং চলতি বছরে আরো বাড়বে।
দেশে কী দক্ষ সিটিও-তে কোনো ঘাটতি আছে?
ভালোর যেমন কোনো শেষ নেই, ঠিক তেমনি দক্ষতার ও সীমানা নেই। আমাদের সিটিও দের দক্ষতা নিয়ে আমাদের কোনও সন্দেহ নেই। তবে হ্যা, আমাদের প্রযুক্তি ভিত্তিক ব্যবসা যেমন বাড়ছে, সেবা যেমন বাড়ছে- সেই সাথে আমাদের দক্ষ প্রযুক্তিবিদ বাড়ছে না। এই দিক টায় আমাদের নজর দিতে হবে।
সিটিওদের দক্ষতা উন্নয়নে আপনারা কী করছেন?
সিটিও ফোরাম বাংলাদেশ সবসময় সিটিওদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা প্রায় সময়ই বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কোলাবরেশনের মাধ্যমে উন্নত কারিকুলামের ট্রেনিং অরগানাইজ করে থাকি আমাদের সিটিও দের জন্যে। সেই সাথে বিভিন্ন সার্টিফিকেশন পোগ্রাম ও ওভার সিজ কোলাবরেশন প্রোগ্রাম ও আয়োজন করে থাকি। আমাদের সেমিনার সিম্পোজিয়াম প্যানেল ডিসকাশনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আমাদের সিটিও দের উপস্থিতি থাকে। সেখানে নিজেদের মধ্যে নলেজ শেয়ারিং এর মাধ্যমে সিটিওরা তাদের দক্ষতা উন্নয়ন করতে পারেন।
২০১৯ সালে সিটিও ফোরামের অর্জনগুলো কী কী?
আপনারা জানেন সিটিও ফোরাম বাংলাদেশ তথ্য প্রযুক্তি খাতে কর্মরত প্রযুক্তিবিদদের জন্য এদেশে একমাত্র সংগঠন। আমাদের সংগঠনের লক্ষ্যই হচ্ছে দেশের প্রযুক্তিবিদদের একত্রিত করে নলেজ শেয়ারিং এর মাধ্যমে দেশের ইনফরমেশন টেকনোলজি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও নীতিনির্ধারনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা। একই সাথে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সাথে দেশের প্রযুক্তিবিদ ও কর্মকর্তাদের সাথে কোলাবরেশন তৈরি করা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে সিটিও ফোরাম আয়োজন করে বেশ কয়েকটি অ্যাওয়ারনেস সেমিনার ও গুরুত্বপূর্ণ মেগা ইভেন্ট। তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে- সিটিও টেক সামিট ২০১৮ এবং এন্টারপ্রাইজ সামিট। এছাড়াও কোলকাতার গ্র্যান্ড ওবেরয়তে ভারতের বিখ্যাত টাইমস অব ইন্ডিয়া ও সিটিও ফোরাম বাংলাদেশের যৌথভাবে আয়োজিত “টেকনোলজি সিনেট বাংলা” সিটিও ফোরামের প্রায় ৪০ জন ডেলিগেটস অংশগ্রহণ করেছে।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সদ্য শুরু হওয়া বছরটিতে ই-লেনদেন সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকবে। এক্ষেত্রে আমরা কতটুকু প্রস্তুত?
এই জায়গাটিতে আমাদের আরো প্রস্তুতির দরকার আছে। সব থেকে বেশি দরকার ই লেনদেনের মধ্যে সচেতনতা। সচেতনতা যদি বাড়ানো যায় তবে ঝুঁকি অনেক আংশেই কমে যাবে।
অ্যাপের ব্যবহার যেভাবে বাড়ছে, সেই সঙ্গে ব্যক্তি তথ্য সুরক্ষা ঝুঁকিও বাড়ছে। এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কী?
স্মার্টফোন গুলোতে আমারা অ্যাপ এর মাধ্যমেই বর্তমানে অধিকাংশ কাজ সম্পাদন করে থাকি। আমাদের অফিসিয়াল তথ্য থেকে শুরু করে ব্যাক্তিগত তথ্য এখন এই স্মার্ট ফোনের মধ্যেই থাকে। কিন্তু আমরা প্রায়ই যে অ্যাপ গুলো স্মার্টফোনে ডাউনলোড করি সেটি কি কি পার্মিশন নিচ্ছে বা কি কি পার্মিশন সেটিকে দেয়া উচিৎ সেই দিকে আমরা খেয়াল করি না। এই সুযোগে অ্যাপ গুলো অনেক অপ্রয়োজনীয় পার্মিশন নিয়ে ব্যাক্তি তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে। আমাদের এই দিক গুলো তে খেয়াল করতে হবে। সেই সাথে অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ ইন্সটল দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
বাংলাদেশে সাইবার ঝুঁকি কোন পর্যায়ে রয়েছে?
উন্নতবিশ্বের মত উচ্চমাত্রার না হলেও বাংলাদেশ সাইবার ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ ঝুঁকি যেমন রয়েছে তেমনি দেশের বাইরের থেকে ঝুঁকি বেশি। আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যাবহারের ফলে হ্যাকাররা খুব সহজেই আমাদের টার্গেট করতে পারে ও সাইবার হামলা ঘটাতে পারে।
সাইবার অপরাধ প্রমাণে আমাদের সক্ষমতা কতটুকু?
সাইবার অপরাধ প্রমাণে আমাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বলতে গেলে খুবই সামান্য। যদিও আমাদের অনেক মেধাবী প্রযুক্তিবিদ রয়েছেন যারা সাইবার ফরেন্সিকের মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণে যথেষ্ট পারদর্শী। তবে তাদের আরো উন্নত প্রশিক্ষণ ও ল্যাবের অভাবে আমরা আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে পারছি না।
দেশে ডিজিটাল অডিট শুরু হয়েছে কি?
দেশে ডিজিটাল অডিট খুব সীমিত আকারে শুরু হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এই ডিজিটাল অডিট শুরু হলেও সার্বিক আকারে এটি খুবই নগন্য। ডিজিটাল অডিট এর গুরুত্ব এখনো অনেক প্রতিষ্ঠান বুঝতে সক্ষম নয়। তাদের বুঝাতে হবে এর গুরুত্ব।
২০১৮ সালে দেশের সাইবার আকাশের সুরক্ষায় আপনি একটি জোটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই ‘ইনফরমেশন সিকিউরিটি অ্যালায়েন্স’ হারিয়ে গেলো কেন?
গত বছর আমি অসুস্থ থাকায় জোট নিয়ে তেমন কিছু করতে পারিনি। এ বছর জুলাইয়ে একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স করবো। এটি হবে সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে।
নতুন শুরু হওয়া বছরের চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
এই নতুন বছর একটি নতুন দশকেরও সূচনা। অনেকাংশেই বলা যায় ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রকাশিত রূপ দেখতে পাবো এই নতুন বছরে। তাই এই বছরের চ্যালেঞ্জ গুলো ও অনেক। পৃথিবী দ্রুতই ক্যাশলেস এর দিকে আগাচ্ছে। আসছে রোবটিক্স অটোমেশন, অগমেন্টেড রিয়েলিটি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির দিকে। নতুন শুরু হওয়া বছরের চ্যালেঞ্জ এগুলো নিয়েই। আগামী ১৮ই জানুয়ারি “সিটিও টেক সামিট ২০২০” আয়োজনে আমরা এই চ্যালেঞ্জ গুলো নিয়েই কথা বলব।