দূর ভবিষ্যতে লাল গ্রহ- খ্যাত মঙ্গলে মানব বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখছেন নাসাসহ অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরা। আলোচিত-বিতর্কিত প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কও আছেন সে দলে। নিজের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের মাধ্যমে একই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করছেন তিনি।
অন্যদিকে, বয়স ফুরিয়ে এসেছে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের। আইএসএস’র মূল অংশীদারদের মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কও ভালো যাচ্ছে না অন্যদের। সর্বশেষ, ২০৩০ সাল পর্যন্ত আইএসএসের খরচ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন।
সব মিলিয়ে, মহাকাশে মানব নভোচারীদের জন্য নতুন একটি নির্ভরযোগ্য স্পেস স্টেশন এখন সময়ের দাবি। সে দাবি মেটানো আর মঙ্গলযাত্রার দুয়ার খোলার চাবিকাঠি নিয়ে বুধবার চাঁদের পথে যাত্রা শুরু করেছে নাসার আর্টেমিস ওয়ান।
এর আগে অবশ্য তিন দফা ব্যর্থ হয় মিশন যাত্রা। প্রথম দুবার কারিগরি জটিলতার কারণে শেষ মুহূর্তে উৎক্ষেপণ বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল নাসা। আর তৃতীয়বার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল আবহাওয়া। চতুর্থ দফাতেও বুধবারে বিপত্তি ঘটেছিল এসএলএস রকেটের কোর স্টেজে তরল হাইড্রোজেন সরবরাহের লাইনে। সে সময় প্রশ্ন উঠেছিল, আবারও কি ভেস্তে যাবে আর্টেমিস ওয়ানের যাত্রা।বিলম্ব না করে তরল জ্বালানী সরবরাহের লাইনে লিক সারাতে লঞ্চপ্যাডে সশরীরে হাজির হয়েছিলেন নাসার ‘রেড ক্রু’ দলের প্রকৌশলীরা। নাট-বল্টু টাইট দিয়ে লিক বন্ধ করে লাইভ প্রচারে ‘থাম্বস আপ’ দেখিয়ে জানান দেন, জটিলতার সমাধান করে ফেলেছেন তারা। তারপর ফের লঞ্চপ্যাডের আশাপাশে নজর রাখা রেডার জটিলতায় উৎক্ষেপণ সাময়িকভাবে স্থগিত করার নির্দেশ আসে কন্ট্রোল রুম থেকে।
তবে সব জটিলতার সমাধান করে দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ উৎক্ষেপণের সবুজ সংকেত আসে নাসার কন্ট্রোল রুম থেকে। ৪০ মিনিট বিলম্বে বাংলাদেশ সময় ১২টা ৪৭ মিনিটে গর্জে ওঠে এসএলএসের রকেট ইঞ্জিনগুলো। এই আনন্দ মুহূর্তটা যথারীতি নিজের টাই কেটে উদযাপন করেন উৎক্ষেপণ মিশনের লঞ্চ ডিরেক্টর চার্লি-ব্ল্যাকওয়েল থম্পসন। উৎক্ষেপণের দুই ঘণ্টার মাথায় ভূপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার মাইলের বেশি উচ্চতায় চাঁদের দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল আর্টেমিস ওয়ান মিশনের মূল স্পেসক্র্যাফট ওরিয়ন, গতি ছিল ঘণ্টায় ২ হাজার মাইলের বেশি। ওরিয়ন স্পেসক্র্যাফটকে কার্যত মহাকাশে ছুড়ে দেওয়ার কাজটি করবে নাসার এসএলএস রকেট।
৫৯ হাজার ৫২৫ পাউন্ডের বেশি ওজনের কার্গো দূর মহাকাশে পাঠানোর লক্ষ্য মাথায় রেখে নকশা করা হয়েছে এসএলএস রকেটের। আর রকেট থেকে আলাদা হওয়ার পর ওরিয়ন স্পেসক্র্যাফটকে চাঁদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগাবে ‘ইন্টেরিম ক্র্যায়োজেনিক প্রোপালশন স্টেজ (আইসিপিএস)’-এর আলএল১০ ইঞ্জিন।
এরপর চাঁদের দিকে একাই এগিয়ে যেতে থাকবে ওরিয়ন। এবারের মিশনে নভোচারী না থাকলেও, নাসা স্পেস ক্যাপসুলটির নকশা করেছে পরবর্তী মিশনে নভোচারীদের বহনের জন্যই। এবার কেবল ওরিয়নের কার্যক্ষমতা আর নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করবে নাসা। ভবিষ্যৎ নভোচারীদের ওপর মহাকাশযাত্রা ও মহাজাগতিক তেজস্ক্রিয়তার সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে মহাকাশযানটির তিন যাত্রীর আসনে থাকবে তিনটি ম্যানিকিন বা মানবাকৃতির পুতুল। পুতুলগুলোর সঙ্গে দুটি সেন্সর জুড়ে দিয়ে রেখেছে নাসা।
কমান্ডার ক্যামপোস ছাড়াও গুরুত্ব পাচ্ছে ওরিয়নের যাত্রী কিউবস্যাটগুলো। ওরিয়ন সব মিলিয়ে ১০টি কিউবস্যাট বহন করছে বলে জানিয়েছে নাসা। তবে, এর কোনোটি নাসার তৈরি নয়।
আর্টেমিস ওয়ান মিশনের জন্য ছোট ছোট স্যাটেলাইটগুলো সরবরাহ করেছে ইতালিয়ান স্পেস এজেন্সি (এএসআই), জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা জাক্সা, লকহিড মার্টিন, ইউনিভার্সিটি অফ টোকিওসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের গবেষণা সংস্থা।
মিশন সফল হলে উৎক্ষেপণ থেকে শুরু করে ওরিয়ন স্পেসক্র্যাফটের পৃথিবীতে ফিরতে সময় লাগবে ২৬ দিন। তবে, মিশনের সময়সূচি নির্ভর করছে ওরিয়ন চাঁদকে ঘিরে ক’বার চক্কর দেয় তার ওপর। চন্দ্রপৃষ্ঠের ৬০ নটিক্যাল মাইল ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার কথা রয়েছে ওরিয়নের। তারপর চন্দ্রপৃষ্ঠের ৩৮ হাজার নটিক্যাল মাইল দূরে থেকে উপগ্রহটিকে ঘিরে চক্কর দেবে মহাকাশযানটি।
পুরো মিশনে কম-বেশি ২১ লাখ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দেবে ওরিয়ন। ফেরার সময় মহাকাশযানটির সর্বোচ্চ গতি হবে ঘণ্টায় ৪০ হাজার কিলোমিটার। পরিকল্পনা মতো সব ঠিক ঠাক থাকলে ১১ ডিসেম্বর পৃথিবীতে ফিরবে ওরিয়ন, অবতরণ করবে প্রশান্ত মহাসাগরের স্যান ডিয়েগো উপকূলে।