ইলেকট্রনিক্স কমার্স শুরু হওয়ার আমেরিকাতে লোকেরা লুফে নিল এই সুযোগ। ফোনকল হোম ডেলিভারী থেকে ইডিআই হয়ে মিনিটেল প্রযুক্তির দ্বারা যখন সাধারণ মানুষ ই-কমার্সের সেবা নিতে শুরু করল। তখন সরকারী এজেন্সি আর কিছু মানুষ ভাবল। বাবারে এ আবার কি জিনিস। পণ্য দেখলাম না, অর্ডার দিলাম, না-চেনা লোককে টাকা দিয়ে না জানি কোন নতুন ঝামেলায় পড়ছে মানুষ। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৮৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট এ্যাসেম্বলি ইলেকট্রনিক্স কমার্স এর উপর একটি গণ শুনানী আয়োজন করে। এতে তখনকার বেশকিছু কোম্পানী অংশ নেয় যারা তখন সীমিত পরিসরে ই-কমার্স শুরু করেছে বা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে অথবা ই-কমার্স সেবার জন্য সিস্টেম তৈরী শুরু করেছে। টেলিকমিউনিকেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পণ্য সেবা বিক্রির অনুমতি আদায়ে তারা যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করে তা কতৃপক্ষকে বোঝাতে সক্ষম হয়। এর ফলে ইলেকট্রনিক্স কমার্স সংক্রান্ত একটি আইনি অনুমোদনের মাধ্যমে বিধিবদ্ধ ই-কমার্সের সূচনা হয়।
বাংলাদেশে বিগত ২০২০ ও ২১ সালে করোনাকালীন সময়ে একদিকে এই খাতের বিকাশ সাধারণ পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে ঠিক সে সময়ে কিছু উচ্চাভিলাসী কিংবা সুযোগসন্ধানী ব্যক্তির ঝুঁকিপূর্ণ মডেলে ব্যবসা পরিচালনার কারণে এই খাতে ঝড় বয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্রেতা, সরবারাহকারী এবং তথাকথিত সৃজনশীল উদ্যোক্তারাও। তারপর সরকার একে কাঠামোবদ্ধ করার চিন্তা করে।
এটি প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসা। আর প্রযুক্তিতে সাধারণ মানুষের দক্ষতা সমপর্যায়ের হবে না এটাই স্বাভাবিক। আর এই সুযোগটাকে কেউ কাজে লাগিয়েছে। তবে এটা কিন্তু খোদ দূর পশ্চিমেও ই-কমার্সের সূচনাকালে হয়েছে। তবে সেখানকার আইন, বিচার ও আর্থিক কাঠামো ভিন্নতর হওয়ায় সেখানকার দূস্কৃতিগুলো আমাদের মতো হয়নি। বিভিন্ন সূত্রে দেখা যায়, ই-কমার্সের প্রাথমিক যুগে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদক বিক্রির জন্য মাদক বেনিয়ারা ই-কমার্সকে বেচে নিয়েছিল। কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে মারিজুয়ানা বিক্রির ঘটনাটা ১৯৭২ সালে ঘটেছিল। এখনো স্মার্ট চোর ডাকাতের অভাব বিশ্বে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাউন্ট হ্যাক করে শত শত কোটি টাকা নিয়ে যাওয়ার ঘটনাই এর স্বাক্ষ্য দেয়।
যুক্তরাষ্টের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং এমআইটি শিক্ষার্থীদের দ্বারা অনলাইনে গাঁজা বিক্রি হওয়ার রটনাও আছে কিন্তু। সেখানে পরবর্তীতে এ ধরনের পরিস্থিতিতে আর পড়তে হয়নি। ততদিনে সরকার ও আইনি বাহিনী সকলে স্মার্ট ও সচেতন হয়েছে বটে। আমরাও এরকম একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
২০২১ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সর্বপ্রথম একটি আন্ত-মন্ত্রণালয় সভায় এই বিষয়ে আইন ও কতৃপক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এই কমিটির ০৩টি সভায় সরকারী বেসরকারী অংশজনদের মতামত নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় যে, এই বিষয়ে আইনের প্রয়োজন নেই তবে পরবর্তীতে কতৃপক্ষ গঠন করা যায়। তবে সাময়িক সমাধান হিসেবে ডিজিটাল কমার্স নীতিমালার ১৮/২/৬ বিধি অনুসারে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। যদিও এর আগে ২০১৯ সালের নভেম্বর বাণিজ্য মন্তণালয় ডিজিটাল কমার্স সেল গঠন করে।
২০২৩ সালে একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের উচ্চ আদালতের মামলায় বিচারক এই বিষয়ে আইন প্রণয়নের একটি নির্দেশনা দিলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘‘ডিজিটাল কমার্স আইন ২০২৩’’ প্রস্তাব করে। পরবর্তীতে অংশীজনেরা এধরনের আইনের অপ্রয়োজনীয়তার কথা বলেন এই বিষয়ে তারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ উপস্থাপন করেন। পাশাপাশি সংগঠিত অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য আইনের শাস্তির বিধানের কথা তুলে ধরেন।
ফলে সরকার ডিজিটাল কমার্স আিইন থেকে সরে আসে এবং ডিজিটাল কমার্স কতৃপক্ষ আইন নামে একটি আইনের খসড়া তৈরী করে। সরকারী ও বেসরকারী খাতের ৬ জন বিশেষজ্ঞের একটি কমিটি এই আইনের পান্ডুলিপিটি তৈরী করেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহাকারী সচিব জনাব সাইফ উদ্দীন আহমেদ, তাকে সহযোযোগিতা করেন ডিজিটাল কমার্স সেল এর জনাব সাইদ আলী। বাংলাদেশ ব্যাংক, ভোক্তা অধিকার ও অন্যান্য খাতের প্রতিনিধি ছিলেন। বেসরকারী খাতের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন ই-কমার্স বিষয়ক লেখক ও প্রশিক্ষক জনাব জাহাঙ্গীর আলম শোভন।
এই খসড়াটি পরবর্তীতে সকল সরকারী বেসরকারী অংশীজনদের দ্বারা পর্যালোচনা করা হয়। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর বেশকিছু আপত্তি আমলে নেয়া হয়। এই খসড়ার সব বিষয়ে যে, ০৬ জনের সকলে একমত হয়েছেন তা নয়। তবে তারা কাজটি সম্পন্ন করতে পেরেছেন।
সর্বশেষ খসড়া কপি ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করার পর দেখা যাচ্ছে এখনো এখানে কয়েকটা আপত্তিকর এবং ঝুকিপূর্ণ ধারা রয়েছে। বিশেষ করে এমন একটি ধারা রয়েছে যেটি থাকবেনা বলে অংশীজনদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি হচ্ছে, দশম অধ্যায়, ব্যক্তিগত দায়মূক্তি। এতে বলা হয়েছে ‘‘ ডিজিটাল বাণিজ্য কতৃপক্ষ অথবা এই আইন বাস্তবায়নের সহিত সংশ্লিষ্ঠ অণ্যকোনো সরকারী প্রতিষ্ঠানের যেকোনো পর্যায়ের কর্মচারী কতৃক ডিজিটাল বাণিজ্য কতৃপক্ষ আইন অথবা এই আইনের অধীনে প্রণীত বিধিমালা কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরল বিশ্বাসেকৃত কোনো কার্যক্রমের ফলে কোনো ডিজিটাল মার্কেট প্লাটফর্ম বা মার্কেটপ্লেস বা অনলাইন বিক্রেতা বা ক্রেতার কোনোরুপ ক্ষতি হইলে অথবা ক্ষতি সাধিত হইবার আশংকা তৈরী হইলে উক্ত কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা করা যাইবেনা। ‘
এই ধারা যুক্তিসঙ্গত নয়, কারণ কোনো ব্যক্তিকে জবাবদিহিতার বাইরে রাখা ঠিক নয় এবং যেকোনো পর্যায়ের কর্মকর্তাকে যেকোনো ক্ষমতাও দেয়া ঠিক নয়। তাছাড়া একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সরল বিশ্বাসে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই তাকে কাঠামোর মধ্যে যথেষ্ঠ সাক্ষ্যপ্রমাণ পূর্বক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কাজ করতে হবে। এমনকি তাতেও যদি ভুল হয়ে যায় তার জন্য জবাবদিহিতা থাকা উচিত। তার দ্বারা ঘটিত কাজ ইচ্চায় নাকি অনিচ্ছায় নাকি অন্য কোনো হয়েছে তা তাকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। তবে আদালত বা কোট কাচারিতে যাওয়ার আগে আভ্যন্তরীণ শুনানীর ব্যবস্থা থাকতে পারে। এতে বেশীরভাগ সমস্যা সমাধান সহজ হয়ে যাবে।
ষষ্ঠ অধ্যায়ের ধারা ২৩ এবং ১৪ এ পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানু এবং কুরিয়ার কোম্পানীকে তাদের কাছে চাহিত তথ্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে বা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে তথ্য প্রদান না করলে এসব কোম্পানীর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা এবং তাদের কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করার বিধান রাখা হয়েছে। অনেকের মতে একটি যুক্তসঙ্গত নয়। তথ্য না দেয়ার ক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় শাস্তি কমও বেশী করা যেতে পারে তবে অন্য দপ্তরের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানের নথিজব্দ সমীচিন নহে।
প্রথমত, গেটওয়ে হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনস্থ আর কুরিয়ার কোম্পানী ডাক বিভাগের অথীনে কাজ করে। তাই ভিন্ন দপ্তর কতৃক এ ধরনের আগ্রাসী শাস্তি ভাল দেখাবে না। এছাড়া একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য না দেয়ার কারণে ডিভাইস জব্দ করা হলে আরো অনেক মানুষের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এই ধারাটিও বিলুপ্তির আহবান জানানো হয়েছে। বলাবাহুল্য এই ধারাটির সাথে প্রথম থেকেই আমি দ্বিমত পোষন করে আসছি।
ষষ্ঠ অধ্যায়ের ধারা ১৬তে ডিবিআইডি ছাড়া ব্যবসা করার শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এতে প্রথমে ১ লক্ষ টাকা জরিমানার কথা হলেও পরে তা ৫০ হাজার টাকায় কমিয়ে আনা হয়। যদিও এটা নিয়ে ই-কমার্স খাত সংশ্লিষ্ঠদের আপত্তি রয়েছে। তাদের বক্তব্য দুটো কারণে এই শাস্তি এই ক্ষেত্রে এত বেশী হারে প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। যেখানে এই খাতে বেশীরভাগ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যাদের ট্রেড লাইসেন্স এখনো ৫শ টাকায় পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকার বিশষয়টি কিছুটা ভারসাম্যহীন। এ ধরনের শাস্তি বড়োজোর ট্রেড লাইসেন্স এর সাথে সমন্বয় করে সে পরিমাণ করা যেতে পারে। তাছাড়া ডিবিআইডি বা ব্যবসা বন্ধ করাই যথেষ্ঠ।
এছাড়া মনে রাখতে হবে ডিবিআইডি নিয়েও ভোগান্তি রয়েছে। এই সেবাটি এখনো পূর্ণতা পায়নি। এ ব্যাপারে আমিআরো একটা লেখা লিখেছি। পাঠক আন্তজালে খুঁজলে সহজে পেয়ে যাবেন। এই বিষয়ে ইতোপূর্বে আমি একাধিক লেখায় সমস্যাগুলো তুলে এনেছিলাম।
এখানে প্রশ্ন আসে আর্থিক প্রতারণা, ক্রেতা ঠকানো, চুক্তিভঙ্গ এসবের কি হবে? বলা বাহুল্য এসব অপরাধের শাস্তি দেশের প্রচলিত বিভিন্ন আইনে রয়েছে। তাছাড়া ভোক্তার অধিকারের জন্য ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯ এর সংশোধনী চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। অন্যান্য অপরাধের জন্য প্রতিযোগিতা আইন ২০১২তে পর্যাপ্ত সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। এই দুটো প্রক্রিয়াতেও আমি সম্পৃক্ত। এমনকি ট্রেড লাইসেন্স আইন ২০১৬কে সংশোধন করার জন্য বিগত ২০১৯ সাল থেকে ক্রমাগত অনুরোধ করা হচ্ছে। কেউ জানে না স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কমে ঘুম ভাঙবে।
এই আইনটি শুধুমাত্র এমন একটি কতৃপক্ষ গঠনের জন্য যে কতৃপক্ষ অপরাধ সংগঠনের পূর্বে নজরদারী করবে এবং ঘটনার পরেও কাজ করতে পারবে। এখন দেখার বিষয় এই আইনের মাধ্যমে গঠিত কতৃপক্ষ কিভাবে বিষয়গুলো সমাধান করে এবং ভবিষ্যত ই-কমার্সের উন্নয়ন. শৃংখলা বিধান ও ক্রেতা স্বার্থ রক্ষায় কতটা ভূমিকা রাখে। যে ৩ টি ধারার কথা এখানে যুক্তিসহ আলোচনা করা হয়েছে। আশাকরি কতৃপক্ষ এগুলো বিবেচনা করবে।