সাইফুর রহমান
বাংলাদেশের আইসিটি খাত বর্তমানে এক সম্ভাবনাময় অবস্থানে রয়েছে। তবে এই খাত থেকে আর্থিক সফলতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ, যা আমাদের স্থানীয় সফটওয়্যারকে বৈশ্বিক মঞ্চে পরিচিত করবে। বৈশ্বিক সফটওয়্যার ব্র্যান্ড তৈরির অভাবের কারণে আমরা এখনও বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে আছি। বিশ্বের অনেক দেশ, যেমন ভারত, ফিলিপাইন এবং ভিয়েতনাম, সফটওয়্যার এবং আইটি সেবা রপ্তানি থেকে বিশাল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। বাংলাদেশও একই পথ অনুসরণ করতে পারে, তবে এর জন্য প্রয়োজন সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং ব্রেকথ্রু প্রযুক্তি উদ্ভাবন।
ভারত বর্তমানে আইটি এবং সফটওয়্যার রপ্তানিতে বছরে প্রায় ১৯৪ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। ফিলিপাইন আউটসোর্সিং এবং কল সেন্টার সেবার মাধ্যমে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার অর্জন করে। আর বাংলাদেশ? আমাদের সফটওয়্যার এবং আইটি রপ্তানির আয় এখনো মাত্র ১.৪ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এই পার্থক্য আমাদের প্রযুক্তি খাতের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলোকে স্পষ্ট করে তোলে। আমরা যদি একটি গ্লোবাল সফটওয়্যার ব্র্যান্ড তৈরি করতে পারি, তবে এই আয়ের পরিমাণ কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব।
একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ডিং কৌশল বাংলাদেশের সফটওয়্যার খাতকে বৈশ্বিক মঞ্চে পরিচিত করতে পারে। মেড ইন বাংলাদেশ” লেবেলকে সামনে রেখে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা প্রয়োজন, যেখানে দেশের সব সফটওয়্যার পণ্য এবং সেবা প্রদর্শিত হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কাস্টমাইজড সফটওয়্যার তৈরি করাও অত্যন্ত জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, জাপান, চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের মতো বাজারে স্থানীয় ভাষায় এবং সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সফটওয়্যার সরবরাহ করা গেলে, নতুন গ্রাহক এবং বাজার তৈরির সুযোগ তৈরি হবে।
এছাড়া, একটি ব্রেকথ্রু প্রকল্প যেমন অপারেটিং সিস্টেম, ডাটাবেজ সিস্টেম, অথবা একটি হেডলেস কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (CMS) তৈরি করা বাংলাদেশের জন্য গেম-চেঞ্জার হতে পারে। বিশ্বের বৃহৎ সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো যেমন Oracle, MySQL বা MongoDB তাদের ডাটাবেজ সিস্টেমের মাধ্যমে বিশাল আয়ের উৎস তৈরি করেছে, তেমনি বাংলাদেশও যদি একটি দ্রুত, স্কেলেবল এবং নিরাপদ ডাটাবেজ প্রযুক্তি তৈরি করতে পারে, তবে এটি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
একটি হেডলেস CMS, যা বর্তমান ই-কমার্স এবং মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির জন্য অত্যন্ত কার্যকর, বৈশ্বিক সেবা খাতে আমাদের নতুন একটি পরিচিতি তৈরি করতে পারে। এই ধরনের উদ্যোগ শুধু অর্থনৈতিক লাভই নয়, বরং বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতের উদ্ভাবনী সক্ষমতাকে বৈশ্বিক পর্যায়ে তুলে ধরবে। আমাদের সম্ভাবনা এবং সক্ষমতা থাকা সত্তে¡ও আমরা কেন বৈশ্বিক সফটওয়্যার বাজারে উল্লেখযোগ্য অবস্থান তৈরি করতে পারছি না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলোর সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
প্রথমত, বাংলাদেশের সফটওয়্যার খাত ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। আমরা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সফটওয়্যার তৈরি করছি, কিন্তু সেগুলোকে বৈশ্বিক গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানোর মতো সঠিক ব্র্যান্ডিং কৌশল নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশ, যেমন ভারত বা ফিলিপাইন, তাদের সফটওয়্যার পণ্য এবং সেবাকে নির্দিষ্ট বাজারের জন্য উপযোগী করে উপস্থাপন করে। অথচ বাংলাদেশে এই ধরনের উদ্যোগের অভাব স্পষ্ট। মেড ইন বাংলাদেশ” লেবেলকে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি শক্তিশালী প্রচারণা এবং ব্র্যান্ডিং কৌশল প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, দক্ষ জনশক্তি তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি রয়েছে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম মেধাবী হলেও, তারা বৈশ্বিক মানের প্রযুক্তি দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রযুক্তিগত শিক্ষার আধুনিকায়ন এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণের সুযোগের অভাব রয়েছে। এটি আমাদের প্রযুক্তি কর্মীদের প্রতিযোগিতার বাইরে ঠেলে দিচ্ছে।
তৃতীয়ত, গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) বিনিয়োগের অভাব আমাদের বড় একটি সীমাবদ্ধতা। বিশ্বের সফল সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো, যেমন গুগল বা মাইক্রোসফট, তাদের সাফল্যের পেছনে বিশাল গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে জ্উ তহবিলের অভাব রয়েছে। এটি উদ্ভাবন এবং নতুন প্রযুক্তি তৈরির পথে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। চতুর্থত, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। আমাদের সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো বৈশ্বিক বাজারে অফিস স্থাপন বা আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের মতো উদ্যোগ নিতে পারছে না। এ ধরনের উদ্যোগ ছাড়া বৈশ্বিক ক্লায়েন্টদের আস্থা অর্জন করা কঠিন।
পঞ্চমত, সরকারি সহযোগিতার অভাবও একটি বড় সমস্যা। কর ছাড়, রপ্তানি প্রণোদনা এবং সহজ শর্তে ঋণের মতো নীতি সহায়তা না থাকায় ছোট ও মাঝারি সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো তাদের কাজ প্রসারিত করতে পারছে না। অনেক দেশ সরকারি সহায়তার মাধ্যমে সফটওয়্যার রপ্তানি বাড়িয়েছে। বাংলাদেশে একই ধরনের নীতিগত সহায়তা অত্যন্ত প্রয়োজন। আমরা সম্ভাবনা হারাচ্ছি মূলত এইসব ঘাটতির কারণে। তবে এই সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব, যদি আমরা সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারি। এজন্য –
প্রথমত, আমাদের একটি সমন্বিত ব্র্যান্ডিং পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, যা মেড ইন বাংলাদেশ” লেবেলকে বৈশ্বিক বাজারে তুলে ধরবে। দ্বিতীয়ত, দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং গ্লোবাল সার্টিফিকেশন প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। তৃতীয়ত, গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারি এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এইসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য ICT এবং একাডেমিয়ার মধ্যে একটি শক্তিশালী সেতুবন্ধন তৈরি করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উৎসাহিত করা এবং তাদের প্রকল্পগুলোকে শিল্পখাতের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলে, এটি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
উদাহরণস্বরূপ, স্ট্যানফোর্ড এবং MIT এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণাগার থেকে গুগল এবং ফেসবুকের মতো কোম্পানি গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও যদি এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে আমাদের তরুণদের উদ্ভাবনী শক্তি ব্যবহার করে বৈশ্বিক মানের সফটওয়্যার এবং প্রযুক্তি তৈরি করা সম্ভব।আমাদের তরুণ প্রজন্ম উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনায় পরিপূর্ণ। তাদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং গ্লোবাল সার্টিফিকেশন প্রোগ্রাম চালু করা হলে, তারা বৈশ্বিক চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। প্রতিটি জেলায় প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা গেলে, তৃণমূল পর্যায় থেকে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব হবে। এই দক্ষ জনশক্তি বিদেশি বাজারে সফটওয়্যার এবং প্রযুক্তি সেবা রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।উচ্চমূল্য সংযোজিত পণ্যের উৎপাদনে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।
সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন, রোবোটিক্স এবং ইলেকট্রনিকস উৎপাদনের মতো খাতগুলোতে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্রয়োজন। ভিয়েতনাম, যা ইলেকট্রনিকস উৎপাদনের ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছে, বছরে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। বাংলাদেশ একই মডেল অনুসরণ করলে বছরে ১৫-২০ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব।বাংলাদেশি সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর জন্য বিদেশে অফিস স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হলে, তারা সরাসরি আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কাজ করতে পারবে। ভারতের TCS এই কৌশল ব্যবহার করে বছরে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোও একই ধরনের পদক্ষেপ নিলে তাদের পণ্যের গুণমান উন্নত হবে এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সহজ হবে। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড তৈরি করা, যা কেবল বাংলাদেশের অর্থনীতিকেই সমৃদ্ধ করবে না, বরং আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে তুলে ধরবে। সঠিক পরিকল্পনা, শিল্প ও একাডেমিয়ার সমন্বয়, এবং গ্লোবাল ব্র্যান্ডিং কৌশলের মাধ্যমে আমরা এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারি। বাংলাদেশকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তির মাধ্যমে বৈশ্বিক সফটওয়্যার বাজারে নেতৃত্ব দেয়ার পথ সুগম করতে হবে। এটি শুধু আর্থিক সফলতা নয়, বরং দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করবে।
লেখক : এফবিসিসিআই সদস্য ও ব্যবসায়ি