চাহিদা বাড়লেও যোগানে অপ্রতুলতা আর ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ভালো নেই ইন্টারনেট সেবাদাতারা। মধ্যসত্বভোগীদের চাপে অতিমারিতে জরুরী সেবা দিতে গিয়ে এখন এই খাতের সেবাদাতাদের অধিকাংশই রয়েছেন আইসিইউতে। কেউ কেউ মৃত্যু মুখে।
খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, অতিমারিতে অফিস-দোকান বন্ধ থাকলেও ঘরের ইন্টারনেটেই চলছে বাণিজ্যিক ও অফিসিয়াল কাজ। ফলে ইন্টারনেটের চাহিদা ৩০ শতাংশ এবং ব্যান্ডউইথ চাহিদা বেড়েছে ২০ শতাংশ।
কিন্তু করপোরেট বা বাণিজ্যিক বিল পাওয়া হয়ে পড়েছে দুস্কর। আবার ঘরে বসেই বাণিজ্যিক কাজ চললেও আবাসিক বিল পেতেও ধরনা দিতে হয় গ্রাহকের দ্বারে দ্বারে। গত ছয় মাসে সেবামূল্য আদায় হার কমেছে ৩০ শতাংশ। সব মিলিয়ে জরুরী পরিস্থিতিতে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা দিতে ব্যয় বেড়েছে ১৫-২০ শতাংশ।
কিন্তু নাগরিক পর্যায়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের ব্যাকবোন খ্যাত ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি সচল রাখতে আপস্ট্রিম পর্যায়ে প্রতি মাসেই পরিশোধ করতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। এতে প্রতিষ্ঠান পরিচালন ব্যয় মেটাতেই এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে সেবদাতাদের। নতুন বিনিয়োগ ছাড়া এখন এই খাতে স্থিত হওয়ায়ই হয়ে পড়েছে দুস্কর। এর ওপর ‘অনিয়মতান্ত্রিক ক্যবাল কাটাকাটি’ এবং ‘ক্যাশ সার্ভার প্রত্যাহার’-কে মরার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশের অন্যতম ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠান আইসিসি কমিউনিকেশন লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম সিদ্দিক মনে করেন, এমন পরিস্থিতি আইএসপিদের অধিকার ক্ষুন্ন করছে এবং এটা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিকাশে অন্তরায়।
তিনি বলেন, ইন্টারনেট আমাদের মৌলিক অধিকার। এই অধিকারকে এখন শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে তুলনা করা হচ্ছে। মাননীয় উপদেষ্টা মহোদয় জনাব সাজীব ওয়াযেদ জয়ের নেত্বত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মানে এক দেশ এক রেট সময়োপযোগী এবং যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, যা সর্বস্তরের মানুষের ইন্টারনেটকে সহজলভ্য করার প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার বা আইএসপিরা লাস্ট মাইল প্রোভাইডার অর্থাৎ প্রান্তিক গ্রাহককে সরাসরি ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে। দেশজুড়ে এই সেবা দেয়ার শুধু অধিকার শুধু সকল লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর। অথচ ইদানিং কিছু বিধি-নিষেধ আসছে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত আসছে যা আইএসপিদের টিকে থাকা দুর্বিষহ করেছে এবং স্বাধীন ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। শুধু নিরাপত্তার অজুহাতে মাঠ পর্যায়ের ক্যাশ সার্ভার তুলে আনার ফলে আইএসপি গুলো সঠিক স্পীডে গুগল বা ফেসবুক সার্ভিস দিতে ব্যর্থ হবে এবং এনটিটিএন নেটওয়ার্ক এর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হবে যা নেওয়ার মতো সামর্থ বর্তমান এএনটিটিএন ও আইআইজিদের নেই। একইভাবে স্থানীয় পর্যায়ে তাদের শক্তিশালী পপ অনুপস্থিত। এতে করে আইআইজি ও এনএনটিএন অপারেটরদের একচেটিয়া ব্যবসায়ের ক্ষেত্র তৈরি করা হবে এবং আইএসপিগুলো কোন ভাবেই বাজার প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না।
এর ওপর বছরের পর বছর ইন্টারনেট সেবা দিলেও এখনো ইন্টারনেট নির্ভার সেবা বা আইটিইএস সেবায় অন্তর্ভূক্ত না হওয়াতেও এই খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে বিস্ময়। অতিমারিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে সরকারের নানা আর্থিক প্রণোদনা থাকলেও তার ছিটে-ফোঁটাও মেলেনি তাদের।
এ বিষয়ে ইন্টারনেট সেবাদাতাদের বাণিজ্যিক সংগঠন আইএসপিএবি মহাসচিব এমদাদুল হক বলেন, আমরা প্রতি বছর আইটিএস নিয়ে দাবি জানাই, মন্ত্রণালয়ে যায়, কিন্তু ফাইনালি হয় না। কেন হয় না বুঝি না। সরকার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বাড়াতে চাইলেও আইএসপিদের দিকে নজর দিচ্ছে না। এনটিটিএনরা এই সুবিধা পেলেও যারা তৃণমূলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট নিয়ে যাচ্ছে তারা কোনো ভাবেই সরকারের কোনো বেনিফিট পায় না।
দেশে ইন্টারনেট সেবার সূচনাকারী আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান দুর্দশায় দুঃখ প্রকাশ করে এই আইএসপিএবি নেতা আরো বলেন, সাবমেরিন এবং আইটিসি আসার আগে আমরা ভি-স্যাটের মাধ্যমে দেশে ইন্টারনেট সেবা দিয়েছি। ব্যান্ডউইথ আমদানি করেছি, নেটওয়ার্ক তৈরি করেছি। এভাবেই জনগণের দোরগোড়ায় ইন্টারনেট পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু এখন মাঝখানে কতগুলো মধ্যস্বত্তভোগী তৈরি করা হয়েছে। আবার এটাও বলে দেয়া হয়েছে যারা আইএসপি ব্যবসা করবে তারা ওই ব্যবসায় করতে পারবে না। এভাবে মধ্যস্বত্ত্ব গ্রুপ প্রতি মাসে আমাদের কাছ থেকে পেমেন্ট নিচ্ছে। কিন্তু অতিমারির সময়ে মানবিক অনেক কারণে আমরা প্রান্তিক পর্যায় থেকে বিল কালেকশন করতে পরি না। ডিজিটাল সংযোগ অটুট রেখেও অনেক টাকা মওকুফ করে দিতে হচ্ছে। যত লস, ঝড়-ঝাপ্টা সব আইএসপিদের ওপর আর উপরে যারা মধ্যস্বত্বভোগী তারা তাদের পেমেন্ট সুন্দর ভাবেই নিয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অনেকে অ্যাডভান্সও নিচ্ছে। এভাবেই আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। আমরা পেটের তাগিদে হয়তো এখনো এই ব্যবসায় চালিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু কতদিন চালিয়ে নিয়ে যাবো তা সময়ই বলে দেবে।
এই হতাশা আর দুঃখবোধ এখন ভর করেছে পুরো আইএসপি খাতের ওপর। পরিস্থিতি বিবেচনায় জীবন ও জীবিকার ঝুঁকির মুখে রয়েছে প্রায় ২ হাজার ব্যবসায়ী এবং পাঁচ লাখের বেশি কর্মী। শঙ্কা দেখা দিয়েছে, প্রান্তিক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে পড়ার।