এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) প্রতিযোগিতায় নতুন এক ঝাঁকুনি এসেছে। গত কয়েকদিন ধরে প্রযুক্তি দুনিয়ায় একটি নাম বেশ ঘুরছে—ডিপসিক (DeepSeek)।
ডিপসিক হলো একটি ফ্রি এআই চ্যাটবট, যা দেখতে এবং কাজে চ্যাটজিপিটির মতো। তবে, এর কাজের ক্ষমতা কতটা ভালো, সেটা সময়ই ঠিক করে দেবে। গণনা এবং কোডিংয়ের ক্ষেত্রে ডিপসিক ওপেনএআই-এর GPT-1 মডেলের সমান শক্তিশালী বলা হচ্ছে। ডিপসিক একটি “reasoning” মডেল, অর্থাৎ এটি ধীরে ধীরে উত্তর তৈরি করে, ঠিক যেমন আমরা চিন্তা করতে করতে সমস্যা সমাধান করি। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি কম মেমরি ব্যবহার করে, ফলে খরচও কম। অন্য চীনা এআই মডেলগুলোর মতো ডিপসিকও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে চলে।
আমেরিকার সিলিকন ভ্যালি, যাকে এআই গবেষণার স্বর্গরাজ্য হিসেবে ধরা হয়, তা ছড়িয়ে এবার চীনের স্টার্টআপ ডিপসিক ৬ মিলিয়ন ডলারে মাত্র দুই মাসে তৈরি করেছে একটি শক্তিশালী এআই মডেল, যা সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। ডিপসিক প্রমাণ করেছে, উদ্ভাবন করতে বড় বাজেটের প্রয়োজন নেই; বরং সৃজনশীলতা এবং সঠিক পরিকল্পনাই আসল মূল। এআই প্রযুক্তির এই নতুন দিগন্ত উন্মোচন চীনকে বিশ্ব মঞ্চে আরও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে এসেছে, যা প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় আমেরিকার জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডিপসিক এমন একটি মডেল তৈরি করেছে, যা OpenAI-এর GPT-4-এর সমান, কিন্তু খরচ ২৭ গুণ কম! তারা ওপেন-সোর্স পদ্ধতিতে কম খরচে এআই তৈরি করেছে, যা আসলে এক নতুন যুগের শুরু। ডিপসিক ৬ মিলিয়ন ডলার দিয়ে যেটা বানিয়েছিল, সেটি OpenAI ৬০০ মিলিয়ন ডলারে বানিয়েছিল! এই উদাহরণটা প্রমাণ করে দেয়, যে এআই তৈরি করতে আর বড় বাজেট বা জটিল হার্ডওয়্যারের দরকার নেই।
ডিপসিকের মডেল ওপেন-সোর্স হওয়ায়, যে কেউ এটি ব্যবহার, পরিবর্তন এবং শেয়ার করতে পারবে, যা প্রযুক্তি দুনিয়ায় নতুন এক ধরনের সহযোগিতা সৃষ্টি করছে। আর মডেলটি পুরোপুরি স্বচ্ছ এবং ব্যাখ্যাযোগ্য হওয়ায়, ব্যবহারকারীরা এটি নিয়ে পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী হতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্র চীনের উন্নত সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল এআই খাতে চীনকে চাপে রাখতে। কিন্তু ডিপসিক সেই চাপকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের মডেল বাজারে এনে বড় ধরনের চমক সৃষ্টি করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। ডিপসিকের উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজারেও প্রভাব ফেলেছে, যেখানে এনভিডিয়া, মেটা, মাইক্রোসফটসহ অনেক বড় এআই প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম কমে গেছে। মার্কিন স্টক মার্কেট প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্য হারিয়েছে এবং শীর্ষ এআই চিপ নির্মাতা NVIDIA তাদের বাজারমূল্য থেকে ৫০০ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে। ডিপসিক দেখিয়ে দিয়েছে যে, উদ্ভাবনের জন্য বিশাল বাজেট বা বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই।

ডিপসিকের উত্থান চীনের জন্য এক বড় অর্জন, যা তাদের প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভরতা এবং শক্তি প্রদর্শন করছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই উত্থানকে ‘ওয়েক আপ’ কল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সিলিকন ভ্যালি এবং ওয়াল স্ট্রিটের বড় খেলোয়াড়রা এখন চাপে, কারণ ডিপসিক বিশ্বব্যাপী বাজারকে চমকে দিয়েছে। এটি চীনা সরকারের “ইনোভেশন ২.০” ধারণার সূচনা, যেখানে তরুণ উদ্যোক্তাদের নেতৃত্বে চীন নিজের প্রযুক্তি ক্ষমতা গড়ে তুলছে। তবে, কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, যদি চীন প্রযুক্তিগতভাবে আরো বেশি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে, তাহলে ভবিষ্যতে কিছু প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে।
ডিপসিক নিয়ে চীনের নতুন এই পদক্ষেপকে প্রযুক্তিবিদরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকম্প বলছেন। এই ভূমিকম্প শুধু কম দামে এআই তৈরি করার কারণে নয়, বরং আমেরিকার চিপ ও প্রসেসরের অহংকারের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী জবাব হিসেবেও দেখা হচ্ছে। ডিপসিকের (চীন) এই পদক্ষেপ এনভিডিয়ার (আমেরিকা) চিপ ব্যবসাকে চ্যালেঞ্জ করছে, আর ট্রাম্প কার্ড হিসেবে, ট্রাম্পের কপাল কতটা কুচকানো হবে, সেটা প্রযুক্তি যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শীঘ্রই পরিষ্কার হবে। ভবিষ্যতে প্রযুক্তি যুদ্ধের ফলাফল কী হবে, সেটা দেখার বিষয়। আমাদের জন্য এটি একটি বড় সুযোগ, কারণ এই যুদ্ধের ফলাফল আমাদেরই পক্ষে থাকবে।