২০০৭ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী, গেটস ফাউন্ডেশন, ইউএসএইড এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে চালু হয়েছিলো এটুআই। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন নামে সরকারি সেবার ডিজিটাল রূপান্তরে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে নাগরিকের কাছে পরিচিত হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ২০১৮ সালে এটুআই প্রোগ্রামকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। সবশেষ ২০২০ সালে ব্যবসাভিত্তিক ‘স্বায়ত্তশাসিত’ ও ‘স্বনির্ভর’ সংস্থা হতে নাম পরিবর্তন করে এসপায়ার টু ইনোভেইট (এটুআই) রাখা হয়। তখন থেকেই সংস্থার নানা বিষয় নিয়ে বের হতে শুরু করে নানা তথ্য। গঠন করা হয় ১৭ সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা পর্ষদ। আইন করে স্বাধীন সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠার তোরজোড় শুরু হয়।
এই পর্ষদ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যবসায় নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন ওঠে। সামাজিক মাধ্যমেও এসব নিয়ে চলে তীর্যক সমালোচনা। সরকার পতনের পর প্রাপ্ত অভিযোগ যাচাইয়ে গত ২০ আগষ্ট এটুআই প্রোগ্রামে কর্মরত ১৪ কর্মকর্তা/কনসালটেন্টকে দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়। এদের মধ্যে ৫ জনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। এই পাঁচ জন হলেন, এসপিএস এর সিনিয়র কনসালটেন্ট এইচ এম আসাদ-উজ্জামান, ই- নথি ইমপ্লিমেন্টেশন এক্সপার্ট এটিএম আল ফাত্তাহ, সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তানভীর কাদের ইমন, এডমিন এর কনসালটেন্ট ওমর ফারুক এবং প্রকিউরমেন্টের সিনিয়র কনসালটেন্ট সালাউদ্দিন। বাকি ৯ জনের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপিকে চিঠি দেওয়া হয়।
বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মুহম্মদ মেহেদী হাসানকে সভাপতি করে তিন সদস্যের এই তদন্ত কমিটিতে যুগ্ম প্রকল্প পরিচালক মোল্লা মিজানুর রহমান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের উপসচিব মো. শাহীনুর আলমকে দায়িত্ব দেয়া হয়। কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। কমিটি বৈঠক করে অভিযুক্তদের অপরাধ সনাক্তে প্রথমে ৫ জন এবং পরে আরো ৯ জনের জনের নথি চেয়ে এটুআই-কে চিঠিও দেয়া হয়। এরা হলেন-পলিসি অ্যাডভাইজার আনির চৌধুরী, ই-গভর্নমেন্ট এনালিস্ট মো. ফরহাদ জাহিদ শেখ, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট মো. মাজেদুল ইসলাম, এইচডি মিডিয়ার প্রজেক্ট এনালিস্ট পূরবী মতিন, টেকনোলজি এনালিস্ট মো. হাফিজুর রহমান, ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট মানিক মাহমুদ, রিসোর্স মবিলাইজেশন স্পেশালিস্ট মো. নাসের মিয়া, ডিএফএস স্পেশালিস্ট মোঃ তহুরুল হাসান, সলিউশন আর্কিটেকচার স্পেশালিস্ট রেজওয়ানুল হক জামী।
তবে এর মধ্যে একই বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে কমিটি গঠন এবং সেখানে কোনো কারিগরি ও নিরীক্ষা কাজে অভিজ্ঞ ব্যক্তি না থাকায় তদন্ত কমিটি নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে তদন্ত কমিটি কাজ স্থগিত করে। পরে ১ সেপ্টেম্বর এই কমিটিতে আরো তিন জনকে সংযুক্ত করা হয়। এই ৬ সদস্যের কমিটিকে তদেন্তের জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয় ১৫ দিন। তবে নতুন কমিটির নাম ঘোষণা এক সপ্তাহ হতে চললেও কার্যত তদন্ত শুরু হয়নি এখনো।
কেন তদন্ত শুরু হতে বিলম্ব হচ্ছে জানতে চাইলে তদন্ত দলের প্রধান মুহম্মদ মেহেদী হাসান জানিয়েছেন, নতুন তিন সদস্যের মধ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মাত্র দুই জনের নাম পেয়েছেন তিনি। এরমধ্যে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প অডিট অধিদপ্তরের পরিচালক হোসাইন আহমেদ শুভ ৪ সেপ্টেম্বর এবং আইএমডি পরিচালক যুগ্মসচিব মাহফুজার রহমানের নাম পেয়েছেন ৫ সেপ্টেম্বর। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউরিকেশন টেকনোলজি (আইআইসিটি), বুয়েট থেকে প্রতিনিধির নাম পাওয়া যাবে। তারা লিখিত চিঠি হাতে না পাওয়ায় সেখান থেকে এখনো কোনো প্রতিনিধির নাম পাওয়া যায়নি।
মেহেদী বলেন, কমিটির সবার নাম পাওয়ার পর বৈঠক করে ফের তদন্ত কাজ শুরু হবে। আগের কমিটি যেহেতু বিলুপ্ত হয়েছে তাই তখন ৩টি বৈঠক করে এটুআইকে চিঠি দেয়া হলেও তার উত্তর পাওয়া যায়নি। পুরো তদন্ত কাজই নতুন করে শুরু হবে। প্রথম বৈঠক থেকে বেধে দেয়া ১৫ কার্য দিবস গণনা শুরু হবে।
কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে এটুআই প্রকল্প পরিচালক মামুনুর রশিদ ভূঁইয়া বলেছেন, অভিযুক্ত ১৪ জনের মধ্যে ৫ জনকে আইসিটি বিভাগ নিয়োগ দিয়েছে। তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নামে বেনামে বিভিন্নভাবে অভিযোগ দাখিল হয়। সে বিষয়ে কমিটি তদন্ত করছে। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটিই ভালো বলতে পারবেন। বাকি ৯ জন ইউএনডিপি’র মাধ্যমে নিয়োগকৃত। সেজন্য তাদের বিষয়ে যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে ইউএনডিপিকে বিভাগ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে এদের সবার বিষয়েই এই তদন্ত কমিটি কাজ করবে বলে জানি।
ইউএনডিপি’র আবাসিক প্রতিনিধি স্টিফেন লিলার এ বিষয়ে বলেছেন, এটুআইয়ের সাথে ২০২৫ সালের চুক্তি শেষ হবে। ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের বিষয়ে আমরা কিছু অভিযোগ পেয়েছি। সেগুলো তদন্ত করছি। আমরা তদন্তের বিষয়টা খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখছি।
অপরদিকে এটুআই এর অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেয়ার নির্দেশনা দিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মোঃ নাহিদ ইসলাম বলেছেন, গত ১৫ বছর ডিজিটাইজেশনের নামে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে আমরা সেগুলো তদন্ত করছি। এটুআই নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। আমরা এটুআই এর পলিসি পরিবর্তন করতে চাই। অনিয়ম দুর্নীতির জন্য আমরা এখনো কাউকে শাস্তি দেইনি। এইটুআই এর ১৪ কর্মকর্তাকে তদন্তের স্বার্থে কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছি। ইউএনডিপি যেহেতু এটুআই এর সাথে জড়িত তাই আমরা তাদেরও তদন্ত করতে বলেছি। এক্ষেত্রে ইউএনডিপি চাইলে তদন্তের স্বার্থে তাদের সহযোগিতা করা হবে।