প্রথমবারের মতো ব্রডব্যান্ড সেবায় ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে ৫শ টাকার সংযোগে গ্রাহককে বাড়তি গুণতে হবে অন্তত ৭৭ টাকা। আর মোবাইল সেবায় অতিরিক্ত ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করায় ১০০ টাকার রিচার্জে কর দিতে হবে ৫৬ টাকার বেশি। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে সম্ভাব্য নতুন খরচের হিসাব থেকে দেখা গেছে, আপস্ট্রিমে প্রতি লক্ষে ৫০০০ টাকার স্থলে ব্যবসায়ীদের গুণতে হবে ১৮ হাজার ২৫০ টাকা। কেননা, ডাউন স্ট্রিমে ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ হিসেবে ১ লক্ষ টাকা রেভিনিউ হলে ৭ হাজার ৫০০ টাকার সঙ্গে সুম্পুরক শুল্ক হবে ১০% যোগ হলে মোট ১৮ হাজার ২৫০ টাকা। আর এর ভার পড়বে প্রান্তিক গ্রাহকের ওপর।
সঙ্গত কারণেই গ্রাহক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, প্রযুক্তিবিদ সবাই এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানব বন্ধনের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন। এছাড়াও রাজস্ব ভবনে ঘেরাও এর মতো কঠোর কর্মসূচিও দিতে যাচ্ছে টেক ইন্ডাস্ট্রি ফোরাম। বিভিন্ন টেক ফোরামে প্রযুক্তিবিদরাও বিরক্ত ও বিতশ্রদ্ধ হয়ে ‘মানুষ রাস্তায় না নামলে কোনো সমাধান নাই’ বলে সংঘটিত হচ্ছেন।
ইন্টারনেটের মূল্যবৃদ্ধির এই উত্তাপ সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক, টুইটার ছাড়িয়ে পৌঁছেছে লিংড ইনেও। সেখানে সক্রিয় টেকনোলজি লিমিটেডে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুবির মাহমুদ চৌধুরী লিখেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সহজ রাস্তায় হাঁটার অভ্যাস বাদ দিয়ে টেকসই সমাধান খোঁজার ব্যাপারে মনোনিবেশ করতে হবে, এবং ইউনুস সরকারকে এই ব্যাপারে তাঁদের উপরে শক্ত চাপ প্রয়োগ করতে হবে। কেননা সব সমস্যার সমাধান তাঁরা পেরাসিটামলে দিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন বলে মনে হচ্ছে; সেই কমফোর্ট জোন থেকে তাঁদেরকে বের করা আনা অত্যন্ত জরুরী।
ক্ষোভ চেপে কৌতুক করে বেসিস সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর লিখেছেন, মদের বার বা রেস্টুরেন্টের জন্য ৩০% সম্পূরক শুল্ক। টেলিফোনের জন্য ২৩%। এই বৈষম্যের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। টেলিফোন আর ইন্টানেটের জন্য একই হারে ৩০% সম্পূরক শুল্ক দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। যেহেতু সরকার মনে করে মোবাইল ফোনে কথা বলা বা ইন্টারনেট ব্যবহার করা ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর জিনিস!
ফেসবুকে শাফায়েত রিয়াদ নামে একজন গ্রাহক লিখেছেন, “কই বাংলাদেশেতো কেউ না খেয়ে নাই” এই বয়ানে কয়েকবার বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম কয়েক দফায় বাড়িয়ে জনজীবন অতিষ্ট করে তুলেছিলো গত সরকার। কথায় কথায় ভ্যাট বসানোর ইচ্ছাও বাস্তবায়ন করেছিলো। তারা এখন নাই। পালাইছে। কারো দুর্নীতি এখন থাকার কথা না যার কারণে রিজার্ভ কমবে,টাকা পাচার হবে। নদী দূষণ না করলে যেমন প্রাকৃতিক ভাবেই পানি পরিষ্কার হয়ে যায় তেমনি অর্থনীতিও ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু উল্টো ভ্যাট দিয়ে অশান্তি বাড়ানোর বুদ্ধি এখন কেন আসলো ?
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মহিউদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, গত ৫ আগস্টের পর অনেকেরই আয় কমেছে। এমনিতেই অনেকে এখনো মুঠোফোন সেবার বাইরে রয়েছেন। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর করের বোঝা আরও বাড়বে। অনেকেই মোবাইল সেবা থেকে আরও বিচ্ছন্ন হয়ে যাবেন। ব্রডব্যান্ড ব্যবহাকারীও কমবে। আসলে এটি একটি হটকারী সিদ্ধান্ত। রোববারের (১২ জানুয়ারি) মধ্যে এটি প্রত্যাহার করতে হবে। না হলে কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।
বিমাফাই’র প্রধান নির্বাহী আলভী নিজাম নাফি বলেন, এই দাম বৃদ্ধির ফলে সরকার ট্যাক্সও কম পাবে (প্রবৃদ্ধি হিসাব করলে) এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এ ক্ষেত্রে ট্যাক্স কমালেই সুফল পাবে।
আশিকুল ইসলাম নামে একজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী বলেছেন, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ০ থেকে একবারে ১০%। অথচ দরকার ছিল এটার মূল্য আরো কমিয়ে গ্রামের মানুষের জন্য নাগালের মধ্যে করা।যাতে করে প্রযুক্তির ছোঁয়া শহর হতে মফস্বলে ছড়িয়ে পরে।
তবে এ নিয়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসায়ী নেতাদের খুব একটা উচ্চ-বাচ্য শোনা যায়নি। স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের সোশ্যাল হ্যান্ডেলগুলো বিগত সরকারের পতনের পর থেকেই মিঁইয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইএসপি ব্যবসায়ীরা জানান, মূলত এতোদিন কোনো আইএসপিই গ্রাহকদের কাছ থেকে ভ্যাট নিতো না। সেবামূল্যের মধ্যেই তা রাখা হতো। এতোদিন ৫ শতাংশ থাকায় এই ক্ষতি সহনীয় ছিলো। প্রত্যেক গ্রাহককে নিজেদের লাভ থেকে থেকে প্যাকেজ প্রতি ২৫ টাকা ছাড় দিতাম। কিন্তু এখন ১০ শতাংশ হওয়ায় ৫০ টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ গ্রাহক পর্যায়েই পড়বে। মাসে ৫০০ টাকা মূল্যের গ্রাহককে ৫৭৭ টাকা দিতে হবে।
শীর্ষ স্থানীয় আইএসপি ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, শুধু শুল্ক বাড়ালেই হবে না তা বাস্তবায়নের জন্য একটি সুষম ব্যবস্থাপনাও জারি করতে হবে। তা না হলে ব্যবসায়ী পর্যায়ে বৈষম্য আরো বাড়বে। বিশৃঙ্খলা শুরু হবে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গ্রাহক না বেড়ে আরো কমবে। কমবে গ্রাহক সেবার মানও।
এর পেছনের যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন, গ্রাহক পর্যায়ের মানসম্মত সেবা ও ভ্যাট চুরি ঠেকাতে এখন পর্যন্ত আইএসপিএবি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বিটিআরসি’র এক্ষেত্রে কোনো দায় না থাকায় সরকারও গ্রাহক প্রতি ভ্যাট প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই স্ব-প্রণোদিত হয়ে আইএসপিএবি-কে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে সিরিয়াস হতে হবে। আইএসপিএবি যদি সবগুলো আইএসপি প্রতিষ্ঠানকে গ্রাহক পর্যায়ের প্যাকেজে অতিরিক্ত ভ্যাটের অংক বিলে যুক্ত করত তা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমার নিশ্চয়তা দেয়, তবেই এতে সুফল আসবে। তা না হলে এই উদ্যোগ বুমেরাং হবে। এতে করে নন লাইসেন্সি আইএসপিদের দৌরাত্ম্যে কমবে। বাড়বে কমপ্লায়েন্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা।
এ নিয়ে আইএসপিএবি’র সাবেক সিনিয়র সহ সভাপতি এবং আইআইজিএবি’র বর্তমান সহ-সভাপতি সাইফুল ইসলাম সিদ্দিক বলেছেন, ইন্টারনেট কোনো বিলাসী পণ্য নয়। বিশেষ করে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট হচ্ছে ডিজিটাল অর্থনীতির রসদ। সেই হিসেবে এর ওপর কোনো ভ্যাট-ট্যাক্স থাকাই উচিত নয়। এতে করে ইন্টারনেট নির্ভর উৎপাদনশীল শিল্প বিশেষ করে সফটওয়্যার, আউটসোর্সিং, বিজনেস অটেমোশন বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে এখনই প্রধান উপদেষ্টার পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সামাজিক ব্যবসা হিসাবে ঘোষণা করা দরকার। এ বিষয়ে নিয়ে ব্যবসায়ী-ভোক্তা সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। তাহলে এই ভুল ভাঙবে। তা নাহলে পিছিয়ে পড়বে দেশের সম্ভাবনাময়ী তথ্যপ্রযুক্তি খাত। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিকাশ থেমে যাবে।