ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ। লাল-সবুজের পতাকায় ওড়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। তারপরও মুক্তির লড়াই চলে অনিঃশেষ। দ্রুতই মাটিতে মিশে যায় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নিহত নূর হোসেনের রক্তের দাগ । অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এলেও গণতন্ত্র অধরাই থেকে যায়। সবশেষ জুলাই-আগষ্ট অভ্যুত্থান। সেলুলয়েড থেকে স্যাটেলাইট। মুক্তির প্রতিটি আন্দোলনেই শক্তি যুগিয়েছে এসব প্রযুক্তি। হানাদার মুক্তির সময় যেমন রেডিও; তেমনি বৈষম্যমুক্তির অভ্যুত্থানে ইন্টারনেট। কিন্তু মুক্তির এই বার্তা কতটা ধারণ করতে পেরেছে সময়ের প্রযুক্তি? সময়ের পরতে পরতে প্রশ্নটা অনুরণিত হচ্ছে পমঞ্চম সভ্যতার পাদপীঠে। প্রশ্ন উঠেছে, দ্বিধা-বিভক্তির চূড়ান্ত মুক্তির; বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের লাড়াইয়ে একাট্টা হওয়ার। এখনো সমান আবেদন রাখছে খাবারের থালার স্বাধীনতা। সাম্য সামাজিক ন্যায় বিচার এবং মানবিক দেশ গঠনের প্রত্যয়। সার্বভৌমত্ব থাকার পরও স্বাধীনতা হারানোর ভয়। সবার জন্য সমান অধিকার; স্বাধীনতা রক্ষার। নিজের পায়ে নিজের মতো ভাববার। এই বিভাজন-দূরত্ব ঘুচতে প্রযুক্তি এসেঠে আশীর্বাদ হয়ে। ইন্টারনেট উন্মুক্ত করেছে জানালা। ঘুচেছে দূরত্ব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকি থোড়াই কেয়ার করেছে আবু সাঈদদের সাহস আর মুগ্ধিদের অকৃত্রিম ভালোবাসায়। কোটি টাকার অ্যাপ, তারুণ্যের গেইম নিয়ে উন্নাসিকতা; তোষামদির তঞ্চকতাকে ছুড়ে দিয়েছে চ্যালেঞ্জের মুখে। প্রযুক্তির শক্তিতে তারুণ্যের দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হয়েছে সময়। জেনজি’রাই রচনা করেছে নতুন এক ইতিহাস।
ওয়েব, অ্যাপ ও গেইমে মুক্তিযুদ্ধ
তথ্যপ্রযুক্তিতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হাজারো কাজ হয়েছে। নিত্যনতুন ওয়েবসাইট যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনি ব্লগেও চলছে ইতিহাস সংরক্ষণ। তৈরি হয়েছে নানা অ্যাপ্লিকেশন ও গেইম। কিন্তু ব্যবহারে পিছিয়ে রয়েছি আমরা। গত দুই দশকে দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে সংগ্রামের নোটবুক, যুদ্ধ জলিল, মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ, জেনোসাইড বাংলাদেশ ডটঅর্গ, আইসিএস ফোরাম ডটঅর্গ, জন্মযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বাংলা গ্যালারি ডটকম, মুক্তিযুদ্ধে উইকি ডটকম, ভার্চুয়াল বাংলাদেশের মতো বেশুমার উদ্যোগ। বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ১ লাখ ২৪ হাজার ৮৫৬টি সংবাদ, ফিচার, চিঠি তথা কনটেন্টের সংগ্রহশালা হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ। মুঠোফোনে সহজে ব্যবহারের জন্য রয়েছে ১৫ টেরাবাইট তথ্যের অ্যাপ। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে রয়েছে ১৯৭৫ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনাপ্রবাহের আর্কাইভ রয়েছে জেনোসাইড বাংলাদেশ আর্কাইভে।
এছাড়াও রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ভার্চুয়াল সংস্করণ তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। ছাড়া ভার্চুয়াল রিয়েলিটির (ভিআর) মাধ্যমেও জাদুঘরের চারটি আলাদা গ্যালারি সফরের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে এটাও থেকে গেছে জনারণ্যে। যেমনটা আলোর মুখ দেখেনি মহান মুক্তিযুদ্ধ, প্রেক্ষাপট ও সমকালীন সমাজের ভিত নির্মাণে নারী ও প্রান্তিক মানুষের অবদান নথিবদ্ধ করার সামগ্রিক প্রয়াস ‘ভয়েসেস অব বাংলাদেশ’। সরকারি অর্থায়নে মোবাইল অ্যাপ ও গেইমও তৈরি হয়েছে। বিপুল অর্থ খরচ করেও তা জনপ্রিয় হয়নি। অর্থ যেন অনর্থ হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনো, একাত্তরের ডায়েরি, বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঘটনাবলী, ইতি বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ, সাত বীরশ্রেষ্ঠ, বিজয় ইতিহাস ইত্যাদি নানা নামে অর্ধশতাধিক অ্যাপ রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অ্যাপ আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। তাকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বেশি কিছু ই-বুকও। বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর উক্তি, বঙ্গবন্ধু অ্যালবাম, ৭ই মার্চের ভাষণ, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, মুজিব ১০০ ইত্যাদি। তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘আমার বঙ্গবন্ধু’ গেইমিং অ্যাপ এবং ৯টি দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক মুভি এবং হলোগ্রাফিও। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত সাড়া জাগানো গেমের মধ্যে একটি হচ্ছে ‘হিরোজ অব ৭১’। অ্যান্ড্রয়েড প্লাটফর্মের গেইমটির বেশ কয়েকটি পর্বও প্রকাশ হয়েছে। খেলা হয়েছে সাড়ে ৭ লাখের মতো। একই ধরনের গেইম ব্যাটল অব ৭১; ওয়্যার ৭১: দ্য ফার্স্ট ডিভেন্স; বিজয় সেভেন্টি ওয়ান হার্ট্স অফ হিরোস; অদম্য একাত্তর; ম্যাসিভ যুদ্ধ-৭১, দ্য ভিক্টোরি, মুক্তি ক্যাম্প ইত্যাদি।
গেইম ছাপিয়ে বৈষম্যবিরোধী যুদ্ধে
তরুণদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের গেইমগুলো ততটা জনপ্রিয় না হলেও। ফিফা-ডটা, পাপজি খেলতে খেলতে তারা ভেঙ্গে ফেলে তারাকাঁটার বাধা। ঢাল-তলোয়ার ছাড়াই মুখোমুখি হয় মারণাস্ত্রের। বুলেটের নিষ্ঠুরতা, আয়না ঘর, গুম, সাইবার যুক্ত করে সব বসয়ীকে। বুকের রক্তে রাঙে সোশ্যাল হ্যান্ডেলের প্রোফাইল। সেই খুনই যেন রাঙিয়েছে অপামর মানুষের হৃদয়। ইন্টারনেট ব্লকআউট ঘি ঢালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে। দমে না গিয়ে তারা টুজি নেটওয়ার্কেই গড়ে তোলে ৫জি বন্ধন। মুঠোফোনে নিয়ার ফিল্ড কমিউনেকেশনে নিজেদের মধ্যে ডিজিটাল যোগাযোগ অটুট রাখে। বেছে নেয় বিজিফাই, টেলিগ্রাম এর মতো অ্যাপ। এক সুর এক লয়ে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের তোড়ে ভেসে যায় স্পাত কঠিন বাঁধ। দেশের বাইরে থেকে এরপর ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ হতে থাকে বর্বরতার ভিডিও। আন্দোলনটাকে মূলত চাঙ্গা রাখেন সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন পেইজের মডারেটররা। টেলিভিশন-কাগজ ছাপিয়ে মূলোতো ডিজিটাল প্লাটফর্মই হয়ে ওঠে অন্যতম মঞ্চ। এই মঞ্চেই তথ্য-উপাত্তের পাশাপাশি বিভিন্ন গান ও কৌতুক, স্যাটায়ার তীব্র ঝাঁকুনি দেয় তারুণ্যের শিরায় শিরায়। নেটিজেন আর টেকক্র্যাঞ্চদের সাহস, স্পর্ধায় স্তম্ভিত হয় গোটা জাতি। তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে যায় যুগত্তীর্ণ দাম্ভিকতা।
তবে এই পর্যায়ে এসে ঝুঁকি বাড়ে অপতথ্যের। ফেইক-ডিপ ফেইক নিয়েই নতুন যুদ্ধে অংশি নিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। প্রতিবেশী দেশ থেকে ছড়ানো ডজন ডজন অপতথ্য ডিবাঙ্ক করে তথ্যসমুদ্রের দূষণমুক্তির নতুন যুদ্ধে নেমেছে এখন এই নেটিজেনরাই। ফ্যাক্ট ওয়াচ, ফ্যাক্ট চেক, ডিসমিস ল্যাব, রিউমর স্ক্যানার…। তবে জুলাই-আগষ্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তিকে জাগরুক রাখতে হলে প্রযুক্তি ব্যবহার শেখানোর পাশাপাশি মনোযোগী হতে হবে সচেতনতায়। কেননা সাইবার যুদ্ধে যে দামামা চারদিকে শুরু হয়েছে সেখানে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ হবে আবেগ এবং বিবেকের দংশন। প্রয়োজন দেশমেপ্রমে টইটম্বুর কন্টেন্ট। কেননা এই ডেটাই হচ্ছে এখন যুদ্ধের অন্যতম রসদ। সেই রসদ মহুর্তেই বিস্ফোরিত হয় ডিজিটাল মাধ্যমে। ভাইরাল আগুনে পোড়ায়। সেই ছাই ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠে ঠিকই আন্দলেনে হারানো ভাইয়ের জন্য কৃত্রিম হাতগুলো বানিয়েছে আমাদের লাভলুরা। কৃত্রিম হাতের মাধ্যমে গরম-ঠান্ডা অনুভূতি পেতে প্রোস্থেটিক্স ও সেন্সর যুক্ত প্রোস্থেটিক রোবটিক নিয়ে গবেষণা করছেন আমাদেরই ভাই হাসান শহীদ। এবার নজর দিতে হবে সাইবার দূতালী ও কূটনীতিতে।
পাশাপাশি গৌরবের ইতিহাস যেন ভুলুন্ঠিত না হয় সেজন্য হলোগ্রাফি আর ইমার্সিভ টেকনোলজিকে আলিঙ্গন করতে হবে আমাদের। অকল্পনীয় মুক্তির বিজয় মহূর্তকে জাগিয়ে রাখতে হবে এই প্রযুক্তিতেই। এক্ষেত্রে নভো থিয়েটার, আর্মি মিউজিয়ামে এবং বিজ্ঞান জাদুঘরের অত্যাধুনিক মুভি বাসগুলো হতে পারে অন্যতম বাহন। সেখানে ৪ডি থেকে ১২ডি ইমার্সিভ টেকনোলজিতে বীরত্বগাঁথা গুলো ছড়িয়ে দিতে হবে প্রজন্মান্তরে। অ-আ, ক-খ’র সঙ্গে পাঠ্য করতে হবে সাইবার এটিকেট। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবোটিক, ব্লক চেইন, ইন্টারনেট অব থিংসের মতো প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করতে আর কখনো যেন ইন্টারনেট বন্ধ না হয় তার নিশ্চয়তা করতে হবে। একইসঙ্গে ডিজিটাল বৈষম্য দূর করতে নিতে হবে বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ। অটোমেশনের পাশাপাশি প্রশিক্ষণকে ফলপ্রসু করতে সিম্যুলেশনেরও দিকেই নজর দিতে হবে বেশি। প্রযুক্তি ব্যবহারের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে জাতীয় ঐক্য আর ভার্চুয়াল বন্ধনেই। কেননা, ভার্চুয়াল বন্ধন যে ঠুনকো নয়; বৈষ্যমবিরোধী আন্দোলনে বিজয় সেই প্রমাণটাই রেখেছে জাতীয় প্রয়োজনে। ইন্টারনেট কেড়ে নিয়ে টুটিচাপা সময়ে দীপ্তিদের সময়োচিত প্রশ্ন; নিকোলদের কান্না প্রমাণ করে দিয়েছে গেটকিপাররাই সব নয়; ইতিহাস রচনা করে দেশপ্রেম; মূল্যবোধ। গ্রাফিতিতে যেই প্রেম, দ্রোহ রাঙিয়েছেন জুলাই-আগষ্ট অভ্যুত্থানের বীরেরা। এই অভ্যুত্থান অটুট রাখতে ইন্টারনেটকে পৌঁছে দিতে হবে ঘরে ঘরে। মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কেননা, ইন্টারনেট ধর্ম-বর্ণ, গোত্র, ধনী-দরিদ্র সবাইকে এক প্লাটফর্মে আনে।