টেলিকমে সাবলিমিন্টারি ডিউটি ও সারচার্জ অযৌক্তিক
গত দুই বছরে দেশে মুদ্রস্ফিতি হয়েছে ৬২ শতাংশ। একই সঙ্গে ডলার খরচ বেগেছে ৩৭. ৬ শতাংশ। ফলে টেলিকম ব্যবসায় খরচ বেড়েছে। গত ছয়টি প্রান্তিকে ক্রমাগত আয় কমেছে অপারেটরগুলোর। একই সঙ্গে কল রোমিং এর জন্য কার্ড থাকার ফলে এর প্রভাব পড়ছে ভোক্তার ওপর। এমন সময়ে বাজেটে ভোক্তা পর্যায়ে কর আরো ৫ শতাংশ বৃদ্ধি এবং বাজেট পাশের পর অর্থ বিলে করপোরেট কর ধরা হয়েছে ৪৫ শতাংশ। ধাপে ধাপে বাড়ছে খরচ। তাই আমাদের আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ কর পরিশোধ করতে হচ্ছে। সেবা দিতে গিয়ে অপারেটরদের ১০০ টাকার ৫৮ টাকা যায় সরকারি কোষাগারে। সব মিলিয়ে একজন গ্রাহক এখন ১০০ টাকার বিনিময়ে আগের ৭৫ টাকার পরিবর্তে ৭২ টাকার সেবা পাচ্ছে। কিন্তু সরকারি খরচ মিলিয়ে ডেটার ক্ষেত্রে ৩৯ টাকাই সরকারি কোষাগারে দিতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতে যৌক্তিক কর নির্ধারণের মাধ্যমে ভোক্তার ব্যবহার বাড়িয়ে রাজস্ব বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটব। সংগঠনটি‘র শঙ্কা, এই করে প্রতিবছরে টেলিকম খাতের ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
বুধবার বনানীতে প্রাসাদ প্যারাডাইজে অ্যাসটব অফিসে অনুষ্ঠিত বাজেট উত্তর সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই জানানো হয়। অ্যামটব মহাসচিব মোহাম্মদ জুলফিকারের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে বাজেট বিশ্লেষণ তুলে ধরেন রবি’র কোম্পানি সচিব ও চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড অ্যাফেয়োর্স অফিসার মোহাম্মাদ শাহেদ আলম এবং বাংলালিংকের চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান।
উপস্থাপনায় নানা উপত্ত তুলে ধরে শাহেদ বলেন, আমরা এই অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি ভোক্তা কর পরিশোধ করা পাকিস্তানের পর্যায়ে রয়েছি। এমন কি ভূমিকম্পের কারণে সারচার্জ নির্ধারণ করা তুরস্ক আমাদের থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই। দেশে এই মুহূর্তে প্রতি মাসে একজন গ্রাহক ৬.৫ জিবি ডেটা ব্যবহার করে। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই হার ২২ শতাংশের মতো। তাই তাদের মূল্য কম বলে মনে হয়। অথচ সিমের ওপর কর বাড়িয়ে এটা নিরুৎসাহিত করবে।
তিনি বলেন, যখনই খরচ বাড়ে তখন ব্যবহার কমিয়ে দেন। এতেই মূলত রাজস্ব কমে। বিনিয়োগকারীরা যখন বিনিয়োজিত অর্থ থেকে লাভ পাবেন না তখন বিনিয়োগও বাড়বে না। দেশে এখন ১১৮ কোটি সিম আছে। কিন্তু ৮ কোটি গ্রাহক ইন্টারনেটের বাইরে। তাই আমরা মনে করি, সাবলিমিন্টারি ডিউটি ও সারচার্জ উঠিয়ে নেয়ার দাবি জানাই। এটা করা হলে ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়বে ২৮ শতাংশ।
করের তাৎক্ষণিক প্রভাব তুলে ধরে তাইমুর রহমান বলেন, এখন ১০০ টাকার সেবা পেতে ১৩৯ টাকা রিচার্জ করতে হবে গ্রাহককে। এছাড়াও তিন দিনের প্যাকেজ উঠিয়ে নেয়ায় এখন আয় কমছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ডেটা থেকে আয় কমেছে ১.২৫ শতাংশ। তাই এবারের বাজেট আমাদের জন্য মরার ওপর খরার ঘা।
গ্রামীণফোনের হ্যান্স মার্টিন হেনরিক্সন বলেন, সিম কার্ডে অতিরিক্ত কর মোবইল পেনিট্রেশনের সঙ্গে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে বাধা হবে। যদি এক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ানো না হয় তবে আখেরে সবার জন্যই ভালো হবে ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে অ্যামটব মহাসচিব মোহাম্মাদ জুলফিকার বলেন, বাজেটের আগেই এসআরও জারি করায় এবং সেখানে তাৎক্ষণিক কার্যকরের আদেশ থাকায় সংসদে বাজেট প্রস্তাবের পর পরই এটা কার্যকর করতে হয়। তবে আমরা মনে করি, আমাদের বাজেট হবে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যভেদী।
সংবাদ সম্মেলনে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনায় দেখানো হয়, টেলিকম খাতের তিন বহুজাতিক কোম্পানি গ্রামীণফোন, রবি আজিয়াটা ও বাংলালিংক ২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) তাদের বিক্রীত সেবার বিপরীতে আয় করেছিল ৭ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। এ সময় এর আগের প্রান্তিকের তুলনায় কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। যদিও পরের প্রান্তিক থেকেই টেলিকম খাতের ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। ২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এ তিন কোম্পানির ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৯২ শতাংশ। পরের দুই প্রান্তিকে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। এর মধ্যে গত পঞ্জিকাবর্ষের চতুর্থ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এ ধারা বজায় রেখে চলতি ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ঋণাত্মক ১ দশমিক ২৪ শতাংশে।
চলতি অর্থবছরের সর্বশেষ হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত এপ্রিল শেষে মোট মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯ কোটি ৩৭ লাখ ৩০ হাজারে। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৮ কোটি ৩৯ লাখ ৫০ হাজার। এছাড়া রবি আজিয়াটার ৫ কোটি ৮৫ লাখ ১০ হাজার, বাংলালিংকের ৪ কোটি ৪৭ লাখ ২০ হাজার ও রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিটকের ৬৫ লাখ ৫০ হাজার গ্রাহক রয়েছে। মোট মোবাইল গ্রাহকের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৫১ লাখ ৫০ হাজার। সে অনুযায়ী, মোবাইল গ্রাহকের বড় একটি অংশ এখনো ইন্টারনেট ব্যবহার করছে না। গ্রাহকপ্রতি ইন্টারনেট ডাটা ব্যবহারের দিক দিয়েও বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে। একইভাবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ভয়েস কল ও এসএমএসের পরিমাণ কমে আসছে। এর বিপরীতে বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী গ্রাহকের সংখ্যা। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে অপারেটরদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ১৫ হাজার ৫৩৩ কোটি মিনিট ‘অন-নেট কল মিনিট’ বিক্রি করে অপারেটররা। এর আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৩৭৪ কোটি মিনিট। ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্রাহকরা অভ্যন্তরীণভাবে এসএমএস ব্যবহার করেছিল ১ হাজার ৮৯০ কোটি ৬৬ লাখ। এর আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫৯৯ কোটি ৬২ লাখ।