তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ব্যক্তিগত পেশার বাইরেও দেশেকে বিনির্মাণে সবাইকে সক্রিয় হতে যুথবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে গড়ে উঠলো নতুন একটি সিভিল সোসাইটি ফোরাম “বাংলাদেশ ২.০ মুভমেন্ট”। জীবনের পরতে পরতে ক্রসকাটিং টেকনোলজি ছড়িয়ে দিতে এই মঞ্চে যুক্ত হয়েছেন দেশ ও দেশের বাইরে বসবাসরত বাংলাদেশী উদ্যোক্তা ও সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্টরা। তারা মনে করেন, প্রযুক্তি, ব্যবসায় ও অর্থনীতি আগামী দিনের পরিপূরক বাস্তবতা।
সোমবার সকালে রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য গ্রুপ ভিত্তিক ওয়েআউট বৈঠকে অংশ নেন তারা। মুক্ত আলোচনার পর ‘রিফর্ম, রিভার্স ও রিবিল্ড’ অর্থাৎ সংস্কার, বৈপরীত্য আর পূণর্গঠন এই তিনটি লক্ষ্যপূরণে ৫টি অ্যাকশন গ্রুপে আলোচনা করেন অর্ধ শতাধিক অংশগ্রহণকারী। তাদের প্রত্যাশা, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিটকে ধারণ করে দেশের প্রয়োজনে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ের মাধ্যমে আবশ্যক কাঠামো ও নীতিমালাগত পরিবর্তন, বিদ্যমান সঙ্কট থেকে উত্তরণ এবং দুর্নীতিমুক্ত ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার থাকবেন তারা।
দেশের প্রথম অনলাইনে চাকরি প্রাপ্তির প্লাটফর্ম বিডিজবস প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুরের উদ্যোগে বৈঠক পরিচালনা করেন মিত্র প্রতিষ্ঠাতা কিশওয়ার হাশেমী।
এসময় বক্তারা ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট বাংলাদেশ ২.০ কে সফল করতে খাত ভিত্তিক দৃঢ় অবস্থান প্রতিষ্ঠায় অজনপ্রিয় কিন্তু নৈতিক ভাবে আবশ্যকী উদ্যোগ বাস্তবায়নে অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশের আইটি ব্যবসায় যেন পাশ্ববর্তী দেশে যেতে না পারে সে জন্য খাত সংশ্লিষ্টদের অগ্রণী ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান বক্তারা। আলোচনায় রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর সাংবিধানিক রিফর্মেশনের পাশাপাশি মিডিয়া ও সুশীল সমাজকে নির্মোহ ভাবে সজাগ থাকার ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। সতর্ক করা হয়, আগামীমে আর কোনো নতুন মফিয়া যেন গেড়ে বসতে না পারে।

বক্তব্যে রকমারি ডটকম সহ-প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদুল হাসান সোহাগ মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও দুর্নীতি রোধে এআই ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং নীতিমালায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তনে ‘গ্রোথ হ্যকিং’ মডেল ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, সিস্টেম বায়াপাস করতে বাংলাদেশের মানুষ খুবই সৃজনশীল। কিন্তু ব্লকচেইন ও এআই এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে।
বিল্ডকন কনসালটেন্সিসের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাব উদ্দিন বলেন, আইসিটি রফতানিতে আমরা পাকিস্তান থেকে পিছিয়ে। টেলিকমে আফগানস্তান থেকেও পিছনে। পলিসির কারণে আমরা ব্যয়ও কমাতে পারছি না। এটা রাজনৈতিক ভাবে মোটিভেটেড পলিসি। তিন মাসের মধ্যে এগুলো সংস্কার করা দরকার।
সিন্দবাদ সহ-প্রতিষ্ঠাতা জিসান কিংশুক হক আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, অনলাইন পরিশোধের সুযোগ থাকলেও থাকলেও এখানে আমরা যতজন আছি কেউই ঘুষ ছাড়া ট্যাক্স দিতে পারিনি। তাই এসব ক্ষেত্রে প্রসেস সিপ্লিফাই করা দরকার।
পাঠাও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম আহমেদ বলেন, বজয়ীদের মাধ্যমে রচিত হয় ইতিহাস। তাই আমাদের শক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুথবদ্ধ হতে হবে। এজন্য রাজনীতি করা দরকার নেই। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমার তো কিছু না। এমন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আগের ভুল পুনরাবৃত্ত করা যাবে না। তাই আমাদের সবাইকে একসঙ্গে আগামী নির্মাণে কাজ করতে হবে।

ইয়্যুথ ফর অল সহ-প্রতিষ্ঠাতা রেহনুমা কায়সার বলেন, তরুণা যে অভ্যুত্থান দেখিয়েছে তা বিশ্বে অনন্য। তাই তাদের এই অবস্থানকে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং হিসেবে ছড়িয়ে দিতে আমাদের যুবকদের নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার। আমি এরই মধ্যে পাড়া উৎসব করেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ডাকাতের মতো বিষয় হ্যান্ডেল করতে পাড়ায় পাড়ায় সামাজিক কল্যাণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা দরকার।
পলিসি অ্যানালিস্ট সাদমান রহমান বলেন, সরকার এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য আমাদের বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের এগিয়ে থাকতে হবে। আর বিগত সময়ে এনটিএমসি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে জিও লোকেশন ও ভিওআইপি টুলস ব্যবহার করছে উল্লেখ করেন টেলিকম উদ্যোক্তা মোস্তাফা মাহমদু হোসাইন।
অর্থনীতিবিদ, লেখক ও সোশ্যাল এক্টিভিস্ট জিয়া হাসান বাস্তবিক রিফর্মের জন্য স্টাবিলিটি দরকার। তবে স্টাবিলিটির অজুহাতে এক জনের মৃত্যুও আমরা মেনে নিতে পারি না। পাশাপাশি আমাদের সহনশীলতা বাড়াতে হবে। গত ১০ বছরে আমাদের ব্যবসায়ের মধ্যভাগটা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এটা মোটেই ঠিক হয়নি। তাই এটা রিবিল্ড করতে হবে। কেননা, একটা ব্যবসা ছোট থেকে মাঝারি এবং এর পর বড় হবে। শুধু ছোট আর বড় ব্যবসায় টিকে থাকলে কোনো ব্যবসাই প্রবৃদ্ধিতে যাবে না।
ব্যারিস্টার মিতি সঞ্জানা বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে যার যার কাজ ভাগ করে নিতে হবে। বাংলাদেশের বিচারবিভাগ কলঙ্কিত করা হয়েছে। জবাবদিহিতা হারিয়েছি। এমন পরিস্থিতিতে পাশ্ববর্তী দেশের গভীর ষড়যন্ত্রে আমাদের আইটি ব্যবসায় তাদের দিকে ডাইভার্ড করে নিয়ে যেতে এখানে অস্থিতিশীল পরিবেশের মিথ্যাচার করা হচ্ছে। তাই আমাদের এখন সতর্ক থাকতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে ফাহিম মাশরুর বলেন, এখন থেকে আমাদের আর সরকারের অনুগ্রহে কোনো কিছু করার দরকার নেই। ব্যবসা করার জন্য আমাদের সারা জীবন পড়ে আছে। আমরা যদি পরিবেশটা সৃষ্টি করতে না পারি তবে টিকে থাকাটাই কষ্টকর হবে।
অন্যান্যের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা সূর্যমুখী লিমিটেডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফিদা হক, ব্রেইন স্টেশন ২৩ ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাইসুল কবির, এমপাওয়ার প্রতিষ্ঠাতা মৃদুল চৌধুরী, টগুমগু সিইও নাজমুল আরেফিন, লাইট অব হোপ প্রতিষ্ঠাতা ওয়ালিউল্লাহ ভূঁইয়া, আস্থা আইটি পরিচালক নাজায়ের নাজি, ইন্সটিটিউট অব ইনফরমেটিক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইআইডি) নির্বাহী প্রধান সাঈদ আহমেদ, ইনোভিশন কনসালটিং ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবাইয়্যাত সারওয়ারপ্রমুখ বক্তব্য রাখেন।