# ভারতে অর্ধশত, গেছেন ব্যাংকক, দুবাইয়েও # বিকল্প নেটওয়ার্ক দাবি # প্রণোদনা দেওয়ার প্রতিশ্রুত প্রতিমন্ত্রীর
বায়ার ধরে রাখতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সীমান্তবর্তী মেহেরপুর, যশোরের বেনাপোল, লালমনিরহাটের মোগলহাটের মতো গ্রামে গিয়ে প্রতিশ্রুত কাজ সম্পন্ন করছেন। সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়ার সুযোগটি কাজে লাগিয়ে জীবিকা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন তারা।
সূত্রমতে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকেও কেউ কেউ কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। এমনকি ব্যাংক, দুবাই ও নেপাল থেকে নিজেদের ব্যবসায় চালিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন উদ্যোক্তা ফ্রিল্যান্সাররা। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সার এখন কাজ করছেন নেপালের রাজধানী কাঠমন্ডু ও পোখরার গ্রামে বসে। সেখানে রয়েছেন দুই শতাধিক ফ্রিল্যান্সার।
প্রিমিয়ার প্রফেশনাল ক্লাবের মাধ্যমে হোটেলে একটি রুমে দুই জন শেয়ার করে বায়ারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কাঠমন্ডুতে থাকা এই ক্লাবের একজন সদস্য মিজানুর রহমান। দৈনিক ৮০০ টাকা রুম ভাড়া দিয়ে ফ্রি ওয়াইফাইন ইন্টারনেট ব্যবহার করে স্বাচ্ছন্দেই তারা কাজ করতে পারছেন বলে জানিয়েছেন। তবে বেশ কয়েকজন নিয়ে নেপালে বসে কাজ করতে আয়ের চেয়ে এখন প্রতিদিন বেশি খরচ পড়ছে বলে জানিয়েছেন ‘স্প্রিংডেভস’ও ‘বিট বাইট টেকনোলজি’র প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও আল-মাহমুদ। মূলতঃ প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতেই এই ব্যয় মেনে নিয়েছেন তিনি।
একইভাবে ইন্টারনেট আউটেজের কবলে পড়ে হত ২৪ জুলাই পাঁচ কর্মীকে নেপালে পাঠিয়ে দেয় এক্সিলওয়েব লিমিটেড নামের একটি আইটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রেসিডেন্ট (অপারেশন) জামিল চৌধুরী জানান, এয়ারপোর্টে নামার পরপরই তিনি তাদের সার্ভার ডাউন হয়ে যাওয়ার নোটিফিকেশন পান। ফলে নেপালের এয়ারপোর্টে বসেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারেন। এরপর দু’জন ঢাকায় ব্যাক করেন। নেপালে এখনও তাদের তিন জনের একটি টিম রয়ে গেছে।’
ইন্টারনেটের ধীর গতি থাকায় আপওয়ার্কের ওয়েব ডেভলপার আতিকুর রহমান জানালেন, তিনি একাই নেপালে গিয়ে তার বায়ারদের সামাল দিতে চেষ্টা করছেন। নেপাল যেতে তার এয়ার টিকিটের (প্লেন ভাড়া) জন্য খরচ হয়েছে ৪০০ ডলার। তবে সেখানে ৪জি নেটওয়ার্কে কাজ করতে পারছেন। এক সপ্তাহ হলো সেখানে আছেন। আক্ষেপ করে তিনি বললেন, একাকী প্রবাস জীবন যাপন করছি। ঘুরতে আসলে ভিন্ন কথা তবে ছোট্ট একটি আইটি ফার্মকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অন্য একটি দেশে এসে থাকা এটা নিষ্ঠুর এবং বিরক্তিকর। এখনো নেট স্পিড স্বাভাবিক হলো না!
তার মতোই রাজশাহীর ফ্লিট বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খায়রুল আলম ব্যাংককে বসে চার সহকর্মীর সঙ্গে ২৫০ কর্মীর জীবিকা সচল রাখার যুদ্ধ করছেন। সামলাচ্ছেন অ্যামাজান ওয়ালমার্টের দৈনিক ২ হাজারের মতো অর্ডার। একইভাবে এআর কমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আসিফ রহমান সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই বসে অফিসের কাজ করছেন। চেষ্টা করছেন তিলে তিলে গড়ে তোলা রিভিউ ও স্টার মার্কগুলো অটুট রাখতে।
বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (বিএফডিএস) এর তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারনেট আউটেজের পর সোমবার পর্যন্ত ১৬১ জন বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সার নেপালে গেছেন। এছাড়া ভারতে গেছেন ৩৩ জন। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরও বেশি। দেশে ইন্টারনেটে ধীরগতি থাকায় আরও অনেকেই যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

আলাপকাল দেশের ভাব মর্যাদা রক্ষায় যে সকল ফ্রিল্যান্সার বিদেশে গিয়ে কাজ চালাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগেই বলছেন, তারা রেমিটেন্স যোদ্ধা হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে যে ৩ শতাংশ প্রণোদনা দেয়া হয় তা সহজে পাননা। ব্যাংকের মাধ্যমে নানা জটিলতার মধ্যে তাদের যেতে হয়। ফ্রিল্যান্সারদের এই দুঃখগাঁথার কথা শেয়ার করেছেন বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিং ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বিএফডিএস) চেয়ারম্যান তানজিবা রহমানও। তিনি বলেছেন, আইটিখাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বেসিসের সদস্যরা যেভাবে ১০ শতাংশ প্রণোদনা পান, সেটা পেতে হলে অনেক লং প্রসেসে (দীর্ঘ প্রক্রিয়া) যেতে হয়। ফ্রিল্যান্সাররা যারা লেগে থেকে প্রণোদনা পান তা ৩ শতাংশের মতো। সেজন্য ৪ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার যে ঘোষণা রয়েছে, সেটি দ্রুত কার্যকর করা জরুরি। তবে ওই প্রণোদনা ছাড়াই নগদ ক্ষতির পাশাপাশি এখন দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকিতে এরিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ে দেশের ভাবমর্যাদা তথা র্যাংকিং ঠিক রাখতে আমরা রীতি মতো যুদ্ধ করছি।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারনেট সমস্যার কারণে ফ্রিল্যান্সারদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে তাদের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে দিতে ফ্রিল্যান্সারদের নগদ প্রণোদনা বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি বলেছেন, ‘ফ্রিল্যান্সাররা যে প্রোডাক্ট এক্সপোর্ট করেন, তা থেকে যে আয় আসে, তার ওপর নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়। সম্প্রতি তাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কিছুটা হলেও পুষিয়ে দিতে এই প্রণোদনাটা একটু বাড়ানো যায় কি না, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমি নিজে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এ নিয়ে কথা বলবো। তাদের নগদ প্রণোদনা যেন ৩ বা ৪ শতাংশ করা হয়, সে বিষয়ে জোর সুপারিশ করা হবে।
এদিকে গত্যন্তর না থাকায় যে সকল ফ্রিল্যান্সার এখন ঢাকা কিংবা অন্যান্য শহরে বসে কাজ করছেন তাদের অধিকাংশই ভিপিএন ব্যবহার করে কমিউনিকেশন করছেন বলে জানা গেছে। তাদের অভিযোগ, নেটের গতি কম থাকায় বায়ারের সঙ্গে কাজ বিনিময়েও বিড়ম্বনায় পড়ছেন তারা। ভিপিএন রিভিউ বিষয়ক ওয়েবসাইট ভিপিএনমেন্টরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে মাত্র চারদিনের ব্যবধানে ভিপিএনের ব্যবহার পাঁচ হাজার শতাংশের বেশি বেড়েছে। প্রতিবেদন বলছে, গত ২২ জুলাই থেকে বাংলাদেশে ভিপিএনের ব্যবহার দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ২৫ জুলাই তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এই সময়ের মধ্যে দেশটিতে ভিপিএন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছিল ৫ হাজার ১৬ শতাংশ। তবে এরপর ধীরে ধীরে সেটি কমতে থাকে। কিন্তু এখনো বাংলাদেশে ভিপিএন ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক সপ্তাহ আগের তুলনায় ২ হাজার ৫০০ শতাংশ বেশি বলে জানাচ্ছে ভিপিএনমেন্টর।
এমন পরিস্থিতিতে নেটওয়ার্ক ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ (নিক্স)-এর মাধমে ইন্টারনেট প্রোটোকল ব্লক অ্যাসাইনের মাধ্যমে শুধুমাত্র আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুততম সময়ে নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কন্ট্যাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্কো), ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব), ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যান্ড প্রাইভেট ইকুইটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ভিসিপিয়াব) ও বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (বিএফডিএস)-এর সদস্য প্রতিষ্ঠান এবং ফ্রিল্যান্সারদের সরকারের দেওয়া আইডি কার্ড নম্বর ধরে আইএসপি ও আইআইজির কাছ থেকে আলাদাভাবে ইন্টারনেট প্রোটোকলের মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেটে যুক্ত করতে এক সঙ্গে কাজ করতে যাচ্ছেন বলে জানাগেছে।
তবে নিক্স এর মাধ্যমে ব্যাপক সংখ্যক ক্লায়েন্টকে সেবা দেয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন আইএসপিএবি সভাপতি ইমদাদুল হক। তিনি বলছেন, ব্যাপক সংখ্যক ক্লায়েন্টকে এভাবে সেবা দেয়া কঠিন। কেননা, ‘নিক্স’ কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান নয়। এক্ষেত্রে পলিসিগত বাধা রয়েছে। আছে নিরাপত্তা ঝুঁকিও। তাই আইআইজি ও আইএসপি সম্মিলিত ভাবে আইটি প্রফেশনালদের জন্য আইডি ভিত্তিক জরুরী ইন্টারনেট সেবার জন্য একটি এমারজেন্সি বিজনেস সল্যুশন বা প্রিমিয়াম লাইন চালু করতে পারে।