এস. এম. ইমদাদুল হক, বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি, গাজীপুর থেকে
প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভরশীল হতে দেশে প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছ সরকার। বিনিয়োগকারী ও কর্মীদের দ্রুত ও সহজ যাতায়াতে বিশেষ ট্রেন সুবিধা চালু করছে। ইউলুপ সিস্টেমের কাজও শেষ হয়েছে। এখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া যায় ৫০ মিনেটেই। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিকে প্রযুক্তির পণ্য উৎপাদনের নতুন হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই যেনো শুদ্ধি অভিযানও শুরু করেছে আইসিটি বিভাগ। শর্ত ভাঙ্গায় তিনটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার হাইটেক সিটি পরিদর্শনকালে শুদ্ধি অভিযানের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে পুরো কর্তৃপক্ষকেই শুদ্ধি অভিযানে আনার পরিকল্পনার কথাও তুলে ধরেছেন ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ কালে লাভজনক হতে আইসিট ও টেলিকমের অধীন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য দক্ষ অভিজ্ঞ বেসরকারি ব্যবস্থাপনা নিয়োগেরও আভাস দিয়েছেন তিনি। নিয়ন্ত্রক নয় সেবক হয়ে দেশের টেলিকম ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে ব্যবসায় বান্ধব করতে নিজের কোনো ভুল-ত্রুটি হলে তাও ধরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী পলক।
৩ কোম্পানির চুক্তি বাতিল, প্রতিস্থাপিত হলো নতুন ৩
বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, চুক্তি বাতিল হওয়া কোম্পানিগুলো হলো- টাইক্কোন সিস্টেমস লিমিটেড( tikkon), ডাটা সফট ও মেট্রোনেট। এগুলোর পরিবর্তে কনা সফট, মা এন্টারপ্রাইজ ও মুমানু পলিয়েস্টার ইন্ডাস্ট্রিজকে পার্কের জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘পার্কের ৩৭০ একর জমির সর্বোত্তম ও কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এমন সিদ্ধান্ত। কিছু কোম্পানির প্লট বাতিল করে সেখানে নতুন কোম্পানিকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।’
প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরও জানিয়েছেন, ২০১৬-২০২৩ পর্যন্ত থেকে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে মোট ১০৭০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। সিটিতে উৎপাদন কার্যক্রম চলমান আছে এমন প্রতিষ্ঠানে মোট ১ হাজার ১১৪ জন কর্মরত। এছাড়া নির্মাণ কার্যক্রমসহ অন্যান্য কার্যক্রমের সাতে জড়িত প্রায় আরও ৫০০ জনবল কর্মরত রয়েছে। এখানে ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, ফাইবার অপটিক ক্যাবল, গাড়ি, সিসিটিভি, এটিএম মেশিন, কিউঙ্ক মেশিন, লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিসহ নানা ধরনের আইটি পণ্য উৎপাদন ও তৈরির কাজ করছে কোম্পানিগুলো।
ভিসতার নতুন কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন

বাতিল ও নতুন বরাদ্দের দিনে, বৃহস্পতিবার মধ্য দুপুরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে ভিসতা ইলেকট্রনিক্স-এর নতুন কারখানা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। এসময় তিনি ভিসতা’র টেলিভিশন ও সম্প্রচার বক্স কারখানা স্থাপন কাজের অগ্রগতির খোঁজন নেন। সেসময় ভিসতা ইলেকট্রনিক্স-এর চেয়ারম্যান সামছুল আলম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক লোকমান হোসেন আকাশ এবং পরিচালক উদয় হাকিম।

ওয়ালটনের নতুন পণ্য উন্মোচন
একই দিনের বিকেলে ওয়ালটনের নেক্সজি মোবাইলফোন ও কমার্সিয়াল এসেসডি উন্মোচন এবং কম্পিউটার পণ্যে শর্তসাপেক্ষে শতভাগ ক্যশব্যাক ঘোষণা করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী। সেসময় ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান এস এম রেজাউল আলম, ম্যানেজিং ডিরেক্টর এস এম মঞ্জুরুল আলম এবং ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি’র পরিচালক ও ওয়ালটন টিভির মনিটরিং ডিরেক্টর রাইসা সিগমা হিমা, ওয়ালটন ডিজি-টেকের অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর লিয়াকত আলী, ওয়ালটন হাই-টেকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. ইউসুফ আলীসহ ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

নতুন বিনিয়োগ সফরের এই দিনে বাংলাদেশী ব্রান্ড হিসেবে স্মার্ট টেকনোলজিস এবং ড্যাফোডিল ল্যাপটপ অ্যাসেম্বলিং (সংযোজন) কার্যক্রম দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন প্রতিমন্ত্রী পলক। তাকে এসময় হাইটেক পার্কের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার স্থাপনের অনুরোধ করেন ড্যাফোডিল গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সবুর খান ও স্মার্ট টেকনোলজিস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম। উভয়েই আশা প্রকাশ করেছেন, মে মাস নাগাদ তারা প্রতিমাসে ১০ হাজার করে নিজস্ব ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ বাজারে সরবরাহ করতে পারবেন। একই সঙ্গে বিদেশেও রফতানি করার স্বপ্ন বুনছেন এই উদ্যোক্তারা।

অপরদিকে দেশজুড়ে উচ্চগতির নিরবিচ্ছিন্ন উৎপাদনমুখী ইন্টারনেট সেবা দিতে এই হাইটেক পার্কেই পূর্ণ্যেদ্যমে কাজ করছে ফাইবার অপটিক কেব্ল ইন্ডাস্ট্রি। সকালেই ফুলেল শুভেচ্ছায় নিজেদের ডেরায় স্বাগত জানান ফাইবার অ্যাট হোম ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈনুল হক সিদ্দিকী। এরপরই প্রতিমন্ত্রী হুন্দাই গাড়ি উৎপাদন কারখানা ও বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের কার্যক্রম ঘুরে দেখেন। এসময় সাবেক আইসিটি সচিব ও উৎপাদন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ফেয়ার গ্রুপের উপদেষ্টা এন এম জিয়াউল আলম প্রতিমন্ত্রীকে কাজের অগ্রগতি অবহিত করেন।
বিডিসিসিএল : “হায়ার অ্যান্ড ফায়ার”

হাই-টেক সিটির ভেতরে ফোর টায়ার জাতীয় ডাটা সেন্টারে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা সভায় প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকারকে বড় বিনিয়োগ করতে হয়েছে ডাটা সেন্টারে। আর এই বিনিয়োগ ঋণ নিতে হয়েছে বিদেশ থেকে। তাহলে এই ডাটা সেন্টার থেকে রিটার্ন আসতে হবে সরকারের কাছে। ডাটা সেন্টারের আয় দিয়ে পরিচালন ব্যয় খরচ করে ডাটা সেন্টার কোম্পানিকে লাভবান হতে হবে। ৭-৮ বছরের মধ্যে ব্রেক ইভেন এ আসতে হবে। আমার একটা টার্গেট আছে, জুনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করার। সে জন্য আমি সকাল থেকে দিন রাত কাজ করছি। আপনারা যারা ৯টা ৫টার বেশি কাজ করতে আগ্রহী না, তাদের স্বাধীনতা আছে আইসিটি বিভাগ ছেড়ে যাওয়ার। কাজ করতে না পারলে আইসিটি বিভাগ ছেড়ে দেন।
পলক আরও বলেন, ডাটা এনালিটিক্যাল সেন্টার বিডিসিসিএল এ আর দেব না। আমাদের পরিকল্পনা ছিল সেটা এখানে করার। আপনাদের পারফরম্যান্স এ আমি খুশি, তবে পুরোপুরি সন্তুষ্ট না। এখানে সার্বক্ষণিক এমডি, ডিএমডি নিয়োগ দিতে হবে। বাকি নিয়োগ বন্ধ থাকবে কারণ মাথা ভারী করব না। যারা দুর্নীতিবাজ, দুষ্ট, কর্তব্য অবহেলা করে এমন কাউকে রাখা হবে না। এটা কিন্তু সরকার না, কোম্পানি। “হায়ার অ্যান্ড ফায়ার” হবে শুধু।
এসময় আইসিটি সচিব সামসুল আরেফিন বলেন, এই হাইটেক পার্কে একটা ট্রেন দরকার। বিনিয়োগকারীরা একটা ট্রেন কিনে নিতে পারে। রেলওয়ের থেকে শুধু রেললাইন ভাড়ায় নেবে। এ বিষয়ে রেলের সাথে একটি সমঝোতা চুক্তি হতে পারে। তবে ট্রেনের মালিক থাকবে বিনিয়োগকারীরা। রেলের সাথে সমন্বয় করে তারা নিজেদের প্রয়োজন মতো ট্রেন চালাবে।
বিডিসিসিএল ব্যবস্থাপনা পরিচলক মোঃ আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে বৈঠকে ডাটা সেন্টারের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা তুলে ধরেন ক্লাউড বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মাহদী উজ জামান।
বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটির জন্য ওয়ান স্টপ সেবা
বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি পরিদর্শনের সময় সোলারিশ ভবন অডিটোরিয়ামে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রতিমন্ত্রী পলক বলেন, বিনিয়োগকারীদের কোনো লাইসেন্সের প্রয়োজনে হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের বাইরে যেন দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে না হয়, সে ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজনে হাই-টেক কর্তৃপক্ষের কাঠামো ভেঙে বাইরে থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে। বিনিয়োগকারীদের হাই–টেক সিটির ভেতর ওয়ান–স্টপ সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে বলেও সভায় জানান তিনি। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আগামী অর্থবছরের শুরুতেই বিষয়গুলো সমাধান হয়ে যাবে এবং বিনিয়োগকারীরা ওয়ানস্টপ সেবার মধ্যে চলে আসবেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, হাইটেক পার্ককে একটি স্মার্ট সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী পাঁচ বছরে সময় এবং অর্থের সাশ্রয় করে জনগণের অধিক সেবা নিশ্চিত করা, রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট এবং প্রকল্পের যৌক্তিকতা যাচাই করার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন। কোথায় কোথায় কেন সমস্যা হচ্ছে তা খুঁজে বের করবো। এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ যেসব দপ্তর বা সংস্থায় বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা দরকার বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধি হয়ে আমি তা করবো।

সভায় আইসিটি বিভাগের সচিব মো: সামসুল আরেফিন ও হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিএসএম জাফর উল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।
হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ৮২টি প্রতিষ্ঠানের নামে জমি বরাদ্দ সম্পন্ন হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এখানে ১৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে এই পার্ক থেকে আইটি পণ্য রপ্তানি শুরু হয়েছে। সকল ব্যবসায়িক কার্যক্রম পূর্ণোদ্দমে চালু হলে এক বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্কে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কালিয়াকৈরে ৩৭০ একর জমিতে গড়ে ওঠা দেশের প্রথম ও সবচেয়ে বড় হাই-টেক পার্ক বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি। হাই-টেক পার্কের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ২৩৯ একরের মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার জন্য বরাদ্দযোগ্য ১১২ একর জমির বরাদ্দ শেষ হয়েছে। অন্যান্য জমি লেক, রাস্তা, বনায়ন, পুকুর, প্রশাসনিক এলাকা, সার্ভিস এলাকা, হোটেল, শপিংমল, হাসপাতাল, স্কুল, খেলার মাঠ, ডরমিটরী ভবন, আবাসিক এলাকা, সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট, ই-ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্লান্ট, বিনোদন এলাকা, বৈদ্যুতিক গ্রিড সাবস্টেশনসহ বিভিন্ন সোসাল আ্যামেনিটিস এর জন্য সংরক্ষিত রয়েছে ও ব্যবহৃত হচ্ছে। পার্ক ডেভেলপারের অধীনে ১৩১ একর জমির মধ্যে ৪৭ একর (৮৪ একর জমি বরাদ্দের অপেক্ষায় রয়েছে) জমি বরাদ্দ প্রদান সম্পন্ন হয়েছে। জমি বরাদ্দপ্রাপ্ত ৮২টি দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২২টি ইতোমধ্যে অবকাঠামো তৈরি করে অফিসিয়াল, অপারেশনাল, উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে।
এছাড়া ১৮টি প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে ও ৪২টি প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো তৈরির কার্যক্রম শুরু করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে। এই পার্ক থেকে প্রতিমাসে ভাড়া (জমি ও স্পেস) বাবদ সরকারের ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা আয় হচ্ছে।