দুই সপ্তাহ ধরে মানববন্ধন, বিক্ষোভ, গণসংযোগ, স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন প্রতিবাদমুখর কর্মসূচির মধ্যেও উপস্থাপনায় মুজিববর্ষের লোগো ব্যবহারে রংপুরে জনরোষের মুখে পড়েছে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)। ফলে সেখানে প্রিপেইড মিটার স্থাপন কাজ স্থগিত করে দিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল।
তিনি বলেছেন, প্রিপেইড মিটার স্থাপন নিয়ে জনগণের দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেই আমরা সভাটির আয়োজন করেছিলাম। কিন্তু সভায় তাদের প্রেজেন্টেশনে মুজিবর্ষের লোগো ছিল। এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। সবাই আমরা এটার প্রতিবাদ করেছি। আমরা মনে করছি, সভাকে বিতর্কিত করার জন্যই এটা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দিয়েছি। এছাড়াও প্রিপেইড মিটার কার্যক্রম বন্ধের জন্যও আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়েছি। এই ঘটনার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকবে।
অবশ্য, নেসকো রংপুরের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম মন্ডল ‘ঘটনাটি অনাকাক্সিক্ষত‘ দাবি করে দুঃখ প্রকাশ করছেন। কীভাবে এটা হলো তা জানার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানিয়েছেন।
তবে এই প্রকল্প বাতিলের দাবিতে এখন সোচ্চার হচ্ছেন স্থানীয়রা। রংপুর মহানগর নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট পলাশ কান্তি নাগ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, প্রিপেইড মিটার প্রকল্পটি ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের অর্থ লোপাটের একটি প্রকল্প। এর মাধ্যমে বিদেশে হাজার হাজার কোটি পাচার করেছে পতিত সরকার। আমরা আন্দোলন করছি এই মিটার স্থাপন না করার জন্য। কিন্তু তারপরও নেসকো প্রকল্পের নামে অর্থ তছরুপের জন্যই জনগণের দাবি উপেক্ষা করে মিটার লাগাচ্ছিল। তারা যে ফ্যাসিস্টের অনুসারী সেটা প্রমাণ হলো সভায় মুজিববর্ষের লোগো ব্যবহার করে। আমরা এই মিটার স্থাপন বন্ধের পাশাপাশি যারা ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছেন নেসকো থেকে তাদের অপসারণ চাই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর মহানগর কমিটির আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতি বলেন, নেসকো প্রিপেইড মিটার স্থাপন বিষয়ে মতবিনিময় সভার প্রেজেন্টেশনে মুজিববর্ষের লোগো ব্যবহার করে অন্তর্বর্তীকালিন সরকার ও ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এটা কোনো ভুল নয় বরং পূর্বপরিকল্পিত। তারা ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগী। তারা ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে প্রমোট করতে চাচ্ছে। নেসকোর সব ফ্যাসিবাদী কর্মকর্তাকে অপসারণ করতে হবে। বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতির তদন্ত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে আমরা মাঠে নামতে বাধ্য হবো।
জাতীয় নাগরিক কমিটির রংপুরের সংগঠক আলমগীর নয়ন বলেন, নেসকো সুকৌশলে সভায় মুজিববাদ বহালের অপচেষ্টা করেছে। এর সঙ্গে উপস্থাপনকারী নেসকোর প্রধান প্রকৌশলীসহ অন্য সবাই জড়িত। আমাদের কাছে তথ্য আছে নিয়োগের সময় তিনি ১০ নম্বরে ছিলেন। সেখান থেকে লাফ দিয়ে এক নম্বর হয়ে নিয়োগ পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের সরাসরি মেকানিজমে তিনি নিয়োগ পেয়েছেন। তাকে দ্রুত অপসারণ করতে হবে। আর এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিদেশে হাজার হাজার কোটি পাচার করেছে পতিত সরকার। আমরা আন্দোলন করছি ওই মিটার স্থাপন না করার জন্য। তারপরও নেসকো প্রকল্পের নামে অর্থ তছরুপের জন্যই জনগণের দাবি উপেক্ষা করে মিটার স্থাপন করছে। তারা যে ফ্যাসিস্টের অনুসারী সেটা প্রমাণ হলো সভায় মুজিববর্ষের লোগো ব্যবহার করে।
প্রসঙ্গত, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গ্রহণ করা প্রিপেইড মিটার লাগানো প্রজেক্ট বাতিল, প্রতি মাসে ডিমান্ড চার্জ, সার্ভিস চার্জ ও মিটার ভাড়া আদায় বন্ধের দাবিতে রংপুরে নেসকো অফিস ঘেরাও ও বিক্ষোভ হয় রবিবার। এর পরদিন সোমবার দুপুরে রংপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে প্রিপেইড মিটার স্থাপন বিষয়ক মতবিনিময় সভা ডাকা হয়। অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে নেসকো। সভায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল সভাপতি হিসেবে স্বাগত বক্তব্য দেন। এরপর রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে নেসকোর আওতাধীন এলাকায় স্মার্ট প্রিপেইড মিটার স্থাপন প্রকল্পের প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী সাইদুল মুরসালিন।
প্রেজেন্টেশন শুরুতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সম্বলিত মুজিব শতবর্ষের লোগো, যা চোখে পড়া মাত্রই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে অংশগ্রহণকারীগণ। এসময় উপস্থিত জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, রংপুর মহানগর নাগরিক কমিটি, বিদ্যুৎ গ্রাহক স্বার্থ সুরক্ষা কমিটি, সাধারণ গ্রাহকসহ অংশগ্রহণকারী অংশীজনরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। একইসঙ্গে বিতর্কিত প্রিপেইড মিটার স্থাপন বন্ধের কথা তুলে এ ঘটনাকে পরিকল্পিতভাবে ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের নকশা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।