স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান প্রকৌশলী এবং বাংলাদেশের গ্রামীণ অবকাঠামোর রূপকার , আইইবির সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে সোমবার বিকেলে রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি)’র সদর দফতরের সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে বিশেষ স্মরণ সভায়।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাহবেন আইইবির প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে আইইবির সম্মানী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো.মঞ্জুরুল হক মঞ্জু।
সভায় স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরে সাবেক ও বর্তমান প্রকৌশলীরা উপস্থিত থাকবেন বলে জানিয়েছেন আয়োজক প্রতিষ্ঠান দি ইঞ্জিনিয়ার্স ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শেখ তাজুল ইসলাম তুহিন।
প্রসঙ্গত, প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কৃষি উন্নয়ন সংগ্রামী মরহুম নুরুল ইসলাম সিদ্দিক ও সমাজ সেবী রত্নগর্ভা মা হামিদা সিদ্দিক’র সন্তান।
তিনি কুষ্টিয়া মিশন স্কুল ও সিরাজুল হক মুসলিম হাই স্কুলে তার বিদ্যালয় জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৬০ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। কুষ্টিয়া কলেজ থেকে তিনি ১৯৬২ সালে আইএসসি পাশ করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি পৌর প্রকৌশলী হিসেবে খুলনা মিউনিসিপ্যালিটিতে বদলি হয়ে যান। তিনি প্রখ্যাত সুফি সাধক কাজী আবু মোকাররম ফজলুল বারীর কন্যা সাবেরা সিদ্দিকার সঙ্গে ১৯৭৪ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
কামরুল ইসলাম সিদ্দিক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি ১৯৬৭ সালে সহকারী প্রকৌশলী (ওয়ার্কাস প্রোগ্রাম) হিসেবে কুষ্টিয়াতে তার কর্মজীবন শুরু করেন পরে । একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ সালের শেষের দিকে তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। ইংল্যান্ডের শেফিল বিশ্ববিদ্যালয়ের টাউন অ্যান্ড রিজিওন্যাল প্লানিংয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের জন্য তিনি ১৯৭৬ সালে ইংল্যান্ডে যান। ইংল্যান্ড থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে বাংলাদেশে ফিরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী বিভাগে (এলজিইডি) গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পিডিবির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আলোচিত গুলিস্থান যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার প্রকল্পের মূল পরিকল্পনাকারী। ঢাকাস্থ কুষ্টিয়া জেলা সমিতি তাকে উন্নয়ন সারথী পদক ২০০২ প্রদান করেছে। তিনি ঢাকাস্থ কুষ্টিয়া সমিতির সভাপতি ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর তার চাকরিতে উন্নতি শুরু হয়। বিশ্বের দাতা দেশগুলোর আস্থা অর্জন করেন এবং দাতা দেশ গুলো তাকে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন। যুদ্ধবিধস্ত দেশকে গড়তে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন প্রয়োজন। সে দিকে তিনি মনোনিবেশ করেন এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী ব্যুরোর এলজিইব’র (LGEB) প্রধান প্রকৌশলী পদে অধিষ্ঠিত হন।
পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী ব্যুরো এলজিইব’র নাম পরিবর্তন হয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) করা হয়। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় সারা দেশের প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি রাস্তা পাকা করেছেন, ব্রিজ, কালভার্ট, পাকা অবকাঠামো তৈরি করে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেন।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে (এলজিইডি) কামরুল ইসলাম সিদ্দিক যে বীজ বপন করেছিলেন, তার ওপর ভিত্তি করেই আজ গ্রামীণ অবকাঠামোর এত উন্নয়ন হয়েছে। তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ ও কর্মবীর। আজ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য যে হাউজিং প্রকল্প, সেটা কামরুল ইসলাম সিদ্দিক’র অবদান। তিনি কখনোই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। এলজিইডি, প্রাইভেটাইজেশন, তিনি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান আরবান ট্রান্সপোর্ট, রাজধানীর অবকাঠামো উন্নয়নে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডের (ডিটিসিবি) নির্বাহী পরিচালকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। আজকের পূর্বাচলেও রয়েছে তার অবদান।
কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ছিলেন বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে অত্যন্ত বিজ্ঞ ব্যক্তি, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক ও দক্ষ ব্যবস্থাপক। সব মিলিয়ে একজন নিষ্ঠাবান, নিবেদিতপ্রাণ ও নিরলস কর্মী। স্থানীয় পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং গ্রামীণ উন্নয়নের প্রথম দিককার একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান ছিল (LGEB)। পরবর্তী সময়ে যেটা তারই নেতৃত্বে এলজিইবি-এলজিইডি হিসেবে একটি বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। জনাব সিদ্দিক’র কাজের পরিচয় পাওয়া যেতো এলজিইডি এর নিউজলেটারের মাধ্যমে। এমন করে এর আগে কোনো প্রকৌশলী উন্নয়ন সম্পর্কে বিভিন্ন খবর জনগণের কাছে তুলে ধরেছেন। তার নেতৃত্বে এলজিইডি হয়ে ওঠে দেশের অন্যতম সফল প্রতিষ্ঠান এবং যার কার্যক্রম বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বিস্তৃতি লাভ করে। সরকারি অর্থ ছাড়াও এলজিইডি-এর কাজে সহায়তায় অর্থ আসে থাকে বহু দাতা সংস্থা ও দাতা দেশ থেকে। তারা সবাই একবাক্যে এলজিইডিকে একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই গণ্য করেন। একজনের জীবনে এমনি একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা একটা বিশাল অর্জন। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক’র একটি বিশাল অবদান হলো এলজিইডি-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। পরবর্তী সময়ে অবশ্য তিনি আরও কয়েকটি প্রকল্প, প্রতিষ্ঠান এবং উন্নয়ন নেটওয়ার্কের (আন্তঃযোগাযোগ কেন্দ্র) সফল নেতৃত্ব দেন।
Rubber Dam, GIS, MRDP ইত্যাদি সৃজনশীল প্রকল্পের উদ্যোক্তা এবং বাস্তবায়নকারী হিসেবে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন একজন নিরলস এবং সফল কর্মী হিসেবে।
২০০৩-২০০৪ মেয়াদে কামরুল ইসলাম সিদ্দিক গ্লোবাল ওয়াটার পার্টনারশীপ সাউথ এশিয়া রিজিয়নের প্রথম চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ ওয়াটার পার্টনারশীপ এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল ফোরাম ফর রুবাল ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্টের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বপালনসহ সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ব্যাপকভাবে নিজেকে সমপৃক্ত আমৃত্যু থেকেছেন।তিনি কুষ্টিয়ার জগতি ইউনিয়নের বড়িয়া গ্রামের মায়ের নামে হামিদা সিদ্দিক কলেজিয়েট স্কুল এবং পিতার নামে নুরুল ইসলাম সিদ্দিক এতিমখানা গড়েছেন।
২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার নিউ জার্সিতে একমাত্র ছেলে সাইফুল ইসলাম সিদ্দিক’র বাসায় ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।