দেশে ২০ লাখ মানুষ অনলাইন জুয়ায় জড়িত। তারা মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসের মাধ্যমে মাসে ১৫০ কোটি টাকার বেশি অবৈধভাবে লেনদেন করে। এভাবে বছরে লেনদেন হয় ১ হাজার ৬০০ কোটি থেকে ২ হাজার কোটি টাকা। ক্রিপ্টো কারেন্সি বা হুন্ডি করে দেশ থেকে পাচার করা হয় এই অর্থ। আর এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশী ফিনটেক প্রযুক্তি।
বিটিআরসি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডি’র অনুসন্ধন থেকে এমন তথ্য মিলেছে। গত আগস্ট মাসে জুয়ায় জড়িত ১৮৬টি অ্যাপ ও লিংক অনুসন্ধান করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।
জুয়ার টাকা লেনদেনে দেশের প্রায় সবকটি মোবাইল ব্যাংকিং এর এজেন্ট নম্বর ব্যবহার হয়। এমন দেড় হাজার এজেন্ট নম্বর বন্ধ করতে সিআইডি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি সুপারিশ করছে।
তবে দেশে জুয়াড়িদের নিজস্ব কোনো অ্যাপ বা সাইট নেই বলে নিশ্চিত করেছে সিআইডি। সূত্র বলছে, বিদেশে তৈরি ও বিদেশ থেকেই নিয়ন্ত্রিত অ্যাপের মাধ্যমেই চলেছে অনলাইন জুয়াড় কারবার। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ রাশিয়া, সাইপ্রাস, আফ্রিকা, ও ভারত থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। এগুলোর মধ্যে অন্তত ৫০টি অ্যাপ বাংলাদেশে তুমুল জনপ্রিয়। এরমধ্যে ১৩টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিং এ আর্থিক সেবা দিয়ে থাকে। এর এজেন্টরা লাখে ৫-৬ হাজার টাকা কমিশন নিয়ে থাকে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাসে দুই-আড়াই লাখ টাকা লেনদেন হওয়া ৩০টি এজেন্ট নম্বর অনুসন্ধান করে সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, দেড় হাজার এজেন্ট নম্বরে মাসে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। এসব কারণে দেশে সার্বিক ভাবে মোবাইল লেনদেনের আকার অনেকক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক বাড়ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অনুসন্ধান বলছে, আন্তর্জাতিক বা দেশে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট, ফুটবলসহ অন্যান্য খেলা ঘিরে চলছে অনলাইন জুয়ার জমজমাট আসর। এসব খেলার সময় সরাসরি ওয়েবসাইট বা অ্যাপসের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে অনলাইন জুয়ার বিভিন্ন আসর বসছে। এগুলোর মধ্যে ওয়ান এক্স বেট, বেট উইনার, পারিম্যাচ, বেট ৩৬৫, লাইন বেট, মেলবেট, ২২ বেট ও পিন আপ সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন সাইট।
সম্প্রতি রাজধানীর তেজঁগাও, বংশাল, লালবাগ ও মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে বেট উইনারে জুয়ার আসর পরিচালনাকারী একটি চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এ নিয়ে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই বেট উইনার সাইটের মাধ্যমে মাসে কোটি কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে সুপার অ্যাডমিন কিংবা মাস্টার অ্যাডমিন নামে রাশিয়া থেকে ওয়েবসাইটটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিভিন্ন দেশে দেখভালের জন্য ম্যানেজার নিয়োগ করা হয়। ম্যানেজার বাংলাদেশে জুয়ার এজেন্ট হিসেবে বিশ্বস্তদের নিয়োগ দেয়। গ্রেপ্তার চারজনই অনলাইন জুয়ার বাংলাদেশি এজেন্ট।’
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জুনে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে। এর আগের মাসে এই অংকটা ছিলো ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা। পরিস্থিত আঁচ করতে পেরে ইতিমধ্যে ৬ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইট ও অ্যাপ ব্লক করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বিটিআরসি)। আরও ২৪৬টি অ্যাপ ও ওয়েবসাইট লিংক ব্লক করতে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুগল, ফেসবুক ও ইউটিউবকে চিঠি দিয়েছে বিটিআরসি।
বিটিআরসি সূত্র জানায়, গুগল প্লে স্টোরে এমন ১৫০টি অ্যাপ রয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি অ্যাপ বিটিআরসি’র আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গুগল মুছে ফেলেছে। বাকি ১৩৬টি অ্যাপ বন্ধেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ফেসবুক এবং ইউটিউবও সম্প্রতি ১৭টি জুয়ার লিংক ব্লক করেছে।
অপরদিবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বাংলাদেশে অনলাইনে জুয়া খেলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টাকার লেনদেন হয় মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (এমএফএস) মাধ্যমে। তাই বিকাশ, নগদ, রকেটসহ সব এমএফএস অপারেটরকে গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টস নিয়মিত মনিটরিং করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড সহজলভ্য হওয়ায় লেনদেনে এগুলোও ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককেও চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।