ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন সেবায় নতুন করে আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করা না হলে এনবিআর ঘেরাওসহ কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা
ব্রডব্যান্ড সেবায় ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং মোবাইল সেবায় অতিরিক্ত ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করায় এবার রাস্তায় নেমেছেন গ্রাহক-ব্যবসায়ী-প্রযুক্তিবিদ সকলেই। শুল্ক আরোপ করায় সম্ভাব্য নতুন খরচের হিসাবে গেছে, ইন্টারনেটের উৎস ব্রডব্যান্ডে আপস্ট্রিমে প্রতি লক্ষে ৫০০০ টাকার স্থলে ব্যবসায়ীদের গুণতে হবে ১৮ হাজার ২৫০ টাকা। এর প্রভাবে ডাউন স্ট্রিমে ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ হিসেবে ১ লক্ষ টাকা আয়ের ৭ হাজার ৫০০ টাকার সঙ্গে সুম্পুরক শুল্ক ১০ শতাংশ যুক্ত হয়ে ব্যয় ১৮ হাজার ২৫০ টাকায় দাঁড়াবে। এতে করে ৫০০ টাকায় এক মাসের বিল গ্রাহক পর্যায়ে বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৭০০ টাকা। অপরদিকে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারে এখন থেকে গ্রাহকরা প্রতি ১শ টাকার সেবা নিলে দিতে হবে ১৪২ দশমিক ৪৫ টাকা (ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও সারচার্জসহ)।
এমন বাস্তবাতায় রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করছেন শতাধিক বিক্ষুব্ধ ইন্টারনেট গ্রাহক। বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসেয়শনের ব্যানারে সমবেত হয়েছেন ব্রডব্যান্ড, মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবসায়ী, ইন্টারনেট নির্ভর সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারাও। তবে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের ইন্টারনেট গ্রহাকদের।
সকাল ১০টা থেকেই প্রেসক্লাবের সামনের ফটকের দেয়ালের বাইরে সমবেত হন বিক্ষুব্ধরা। সাড়ে ১০টার দিকে বিক্ষোভে যোগ দেয় টেকনোলজি ইন্ডাস্ট্রি পলিসি অ্যাডভোকেসি প্লাটফর্ম (টিপাপা) ও ভয়েস ফর রিফর্ম। এরপর দেখা যায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের। একই সময়ে মিরপুর আইএসপি অ্যালায়েন্স (মিয়া), আইএসপিএবি, ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরাম, ফ্রিল্যান্সার কমিউনিটি প্রতিনিধিদের দলে দলে যোগ দিতে দেখা যায় মানববন্ধন কর্মসূচিতে।

ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করে নিরবিচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক চাই, সবার জন্য ইন্টারনেট ডিভাইস চাই, দুর্নীতি ও জনবান্ধব এনবিআর চাই এবং সর্বোপরী ইন্টারনেটের ওপর বৈষম্যমূলক কর বাতিলের দাবি সম্মিলিত প্লাকার্ড বহন করছেন মানববন্ধেনে অংশগ্রহণকারীরা। ভয়েস অব রিফর্মস এর প্লাকার্ডে শোভা পেয়েছে জনগনের ওপর কর না বাড়িয়ে সরকারি অপচয় বন্ধ করুন, ইন্টারনেটের ১০০ টাকার ৭০ টাকই সরকারের পকেটে, ইন্টারনেট না থাকলে জুলাই বিপ্লব হতো না।
মানববন্ধন থেকে ইন্টারনেট নিয়ে নয় ছয় করলে তীব্র আন্দোলন এমন কি এনবিআর ঘেরাও করার হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বক্তারা। রিক্সাচলক থেকে শুরু করে সাংবাদিক, বেসরকারি চাকরিজীবি, ব্যবসায়ী নেতা, রাজনীতিক ও ফ্রিল্যান্সারসহ সব শ্রেণী-পেশার নাগরিকদের এই বিক্ষোভে অংশ নিতে দেখা গেছে। বেলা ১১টা নাগাদ মানবন্ধনটি প্রেসক্লাবের সামনের দেয়ালের সীমা ছাড়িয়ে যায়। আশপাশ মিলিয়ে প্রায় হাজার খানেক লোক সমবেত হন এই বিক্ষোভে।
মানববন্ধনে মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মানব বন্ধনে বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরামের চেয়ারপারসন (বিআইজিএফ) মোহাম্মদ আমিনুল হাকিম, বেসিস সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সাবেক পরিচালক খালিদ আবু নাসের, ভয়েস ফর রিফর্ম সমন্বয়ক ফিদা হক প্রমুখ বক্তব্য রাখছেন। এসময় আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সেবার ওপর আরোপিত সম্পূরক কর প্রত্যাহার করা না হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।

এসময় মোহাম্মদ আমিনুল হাকিম বলেন, আমরা স্পষ্ট করে সরকারকে বলতে চাই, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে যারা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে তার শতভাগ দেশীয় উদ্যোক্তা। তাই আমরা বুঝতে পারছি না বর্তমান সরকার কার স্বার্থে এই দেশীয় উদ্যোক্তাদের গলাটিপে মেরে ফেলতে চাচ্ছেন। এ সেবা খাত ধ্বংস করার অপচেষ্টা আগেও করা হয়েছে এখন আবার নতুন করে ১০ শতাংশ এসডি ও সঙ্গে ভ্যাট যুক্ত করায় গ্রাহকের ভোগান্তি যেমন বাড়বে একইভাবে এই সেবাখাত ধ্বংস হয়ে যাবে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে যদি এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করা হয় তাহলে আমরা গ্রাহক এবং সেবা খাতের সবাইকে নিয়ে এনবিআর কার্যালয় ঘেরাও করব।
ফাহিম মাশরুর বলেন, আমরা মনে করি, সরকারের রাজস্ব আয়ে শুল্ক বাড়ানোর অনেক জায়গা আছে। অনেক বাজে খরচ হচ্ছে। তবে ইন্টারেনেটের ওপর কোনো কর আরোপ করা হবে আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। তাই আমাদের আইসিটি ইন্ডাস্ট্রির সবাই আজ এখানে সমবেত হয়েছে। সার্ভিস প্রোভাইডার্স, এক্সপোর্টার্স, ফ্রিল্যান্সার সবাই উপস্থিত হয়েছে।
জুলাই বিপ্লবের পর সরকার কিভাবে এমনটা করছে তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, অতীতে এই খাতে একক ব্যাবসায়ী সুবিধা দিয়ে ইন্টারনেটের দাম বাড়ানো হয়েছিলো। এবার যখন শুল্ক আরোপ করা হলো তখন যারা অতীতে ফ্যাসিস্ট সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা পালন করছে তাদেরই মহার্ঘ্য ভাতা দেয়া হচ্ছে। ইন্টারনেটের ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়িয়ে জুলাই অভ্যূত্থানপূর্ব অবস্থায় যেমন ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিলো তেমন পাঁয়তারা চলছে।
আবু নাসের বলেন, নতুন করে পরের বোঝা জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলবে না সরকারকে ১০ নম্বর সংকেতে ফেলবে। হঠকারী মূলক সিদ্ধান্ত দ্রুত প্রত্যাহার করতে হবে।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, গ্রাহকের ডাকে সাড়া দিয়ে সবাই আজ মানব বন্ধনে হাজির হয়ে প্রমাণ করেছে ইন্টারনেটের ওপর কোনো রকম ভ্যাট-ট্যাক্স কারোই কাম্য নয়। দুর্নীতিবাজ রাজস্ব কর্মকর্তাদের খুশি করতেই তাদের পরামর্শে এই ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আমরা ভেবেছিলাম ৫ই আগস্ট এর পর আর রাজপথে দাঁড়াতে হবে না। কিন্তু আজ দুঃখের সাথে আমাদের রাজপথে দাঁড়াতে হলো।

স্টার্টআপ কমিউনিটি থেকে মানববন্ধনে অংশ নিয়ে পাঠাও সিইও ফাহিম আহমেদ বলেন, ইন্টারনেট আমাদের রুটি-রুজী। এর ওপর আঘাত আসলে আমরা অতীতেও বসে থাকিনি। আগামীতেও থাকবো না। সরকারকে ভুলে গেলে চলবে না ইন্টারনেট বন্ধ করেই ফ্যাসিস্ট সরকারের বিদায় ঘটেছে। দাম বাড়ানোটাও ইন্টারনেট বন্ধের শামিল।
বৈষম্যবিরোধী আইএসপি জোটের সমন্বয়ক জোবায়ের আলমাহমুদ হোসাইন বলেন, ইন্টারনেটের আঁতুর ঘর ব্রডব্যান্ড। এই সেবাকে উন্মুক্ত রাখতেই হবে। এই সেবার ওপর কোনো ভ্যাট-ট্যাক্স থাকা উচিত নয়। ইন্টারনেট এখন আর বিলাসীতা নয়। তারপরও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ৭টি জায়গায় ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ইন্টারনেট ডিজিটাল সেবার প্রাণ। তাই সবাইকে মিলেই এর প্রতিবাদ করতে হবে।