ক্যমেরাযুক্ত একটি ক্ষুদ্র ড্রোন- চলে সূর্যের আলোর শক্তিতে। এদের অনেকগুলোর বিন্যাস এমন ভাবে করা যেন এটি পাখি, মৌমাছির মতো ঝাঁক কিংবা হাঁসের মতো দল বেধে চলতে পারে। ব্যাপক এলকায় ভুমি ধ্বস ঠেকানোর সার্ভে করতে পারে। পারবে প্রিসিশন এগ্রিকালচার মডেলে একসাথে কয়েক হেক্টর জমিতে মাটির ময়শ্চার পরীক্ষা, ফসলের রোগ নির্ণয়, কোথায় পানি লাগবে, কোথায় ঔষধ .. ইত্যাদি দেখভাল করতে। এখন পর্যন্ত আকারে সবচেয়ে ছোট সৌরশক্তির এই ড্রোনটি উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন বাংলাদেশী। নাম তার ড. হাসান শহীদ। কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটিয়ারিয়াল সায়েন্স এর শিক্ষক (রিডার) এবং গবেষক। বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানার হানুয়া গ্রামে জন্ম। বরিশাল ক্যাডেট কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে কমনওয়েলথ বৃত্তি পেয়ে শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে রোবটিক্সে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেছেন। গবেষণার পাশাপাশি বিশ্বাবিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষায় অসামান্য অবদান রাখার জন্য প্রথম বাংলাদেশী আক্যাডেমিক হিসেবে ইউকের সবচেয়ে সম্মনাজনক শিক্ষা পুরস্কার ‘ন্যাশনাল টিচিং ফেলোশিপ (এনটিএফ)’ অর্জন করেছেন। আলাপচারিতায় গবেষণা ও উদ্ভাবনের নানা কথা তুলে ধরলেন ডিজিবাংলাটেক নির্বাহী সম্পাদক ইমদাদুল হক- এর সঙ্গে।।
প্রশ্ন: ছিলেন ক্যাডেটে। সেখানে কঠোর নিয়ম – কানুনের ফাঁকে রোবটিক্সে আগ্রহী হলেন কিভাবে?
উত্তর: ক্যাডেট কলেজের নিয়ম কানুন ক্যাডেটদের ব্যালন্সড হয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করে, আগ্রহ, উদ্দীপনায় বেড়াজাল তৈরি করে না। সেভেনের বিজ্ঞান ক্লাসে স্যাররা যখন বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে মজার ঘটনা বলতেন, তখন থেকে বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল আগ্রহ জন্মে। আমার সুস্পষ্ট মনে আছে, ‘ভবিষ্যতে কি হতে চাই’, এক স্যারের এমন প্রশ্নের জবাবে বিজ্ঞানী হতে চাই বলেছিলাম। তবে কোন বিষযে বিজ্ঞানী হতে চাই তা জানতাম না। রোবটিক্সেরে ব্যাপারে আগ্রহ আসে পরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্সে পড়ার সময়। তখন স্যাররা রোবটের গল্প শোনাতেন। আমাদের কয়েকজন স্যার রোবটিক্সের উপর বিদেশে পিএইচডি করছেন জেনেছিলাম। আমারও রোবটিক্সে গবেষণা করার ইচ্ছা জাগে। কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে আমি শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে রোবটিক্সে পিএইচডি সম্পন্ন করি।
প্রশ্ন: শুরুতেই গবেষণার আপডেট জানতে চাই।
উত্তর: আমার গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা একশ’ এর উপরে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১৫ জন ছাত্র আমার অধীনে পিএইচডি ডিগ্রী সম্পন্ন করেছে এবং বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকসহ ৫ জন ছাত্র তার অধীনে পিএইচডি গবেষণা করছেন। সোলার ড্রোন ছাড়া মানুষের পরিপাকতন্ত্র ইন্সপেকশন এবং রোগ শনাক্ত করনের উপযোগী ক্যাপসুল রোবট, অনুভূতি সম্পন্ন কৃত্রিম হাত (প্রসথেটিকস), বয়স্ক এবং ডিস্যাবল লোকদের সহায়তা করতে পারে এমনসব রোবট নিয়ে গবেষণা করছি।
প্রশ্ন: সোলারকপ্টার বানানোর উৎসাহ পেলেন কিভাবে।
উত্তর: শেফিল্ডে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু হেলিকপ্টারের উপর গবেষণা করতো। পিএইচডি থিসিস জমা দিয়ে ভাইভার জন্য আমার অপেক্ষা। হাতে কিছুটা সময়। আমি সে বন্ধুর সাথে হেলিকপ্টার গবেষণায় যোগ দেই। আমরা দুটি যৌথ গবেষণা পত্র প্রকাশ করতে সক্ষম হই। কুইন মেরিতে শিক্ষক/গবেষক হিসবে যোগ দেয়ার পর রোবটিক্স এবং হেলিকপ্টার নিয়ে গবেষণা শুরু করে। হেলিকপ্টারের একটা ভার্সন হলো কোয়াডরোটর ড্রোন। এগুলো আসলে রোবটিক্সেরই অংশ। এদের বলা হয়, অ্যারিয়াল রোবেটস। ভিডিও ধারণের জন্য ক্যামেরাযুক্ত কোয়াডরোটর ড্রোন খুব জনপ্রিয়। শুরু হয় কোয়াডরোটর ড্রোনের উপর গবেষণা। এরা ব্যাটারিতে বিধায় আকাশে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। ব্যাটারির শক্তি শেষ হয়ে যায়। আবার ব্যাটারির সংখ্যা বাড়াতে গেলে ভর বাড়ার কারণে উড়ার প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। এ অসুবিধা দূর করার লক্ষ্য নিয়েই সোলারকপ্টার গবেষণা শুরু।
প্রশ্ন: চারটি প্রোপেইলার বা পাখা থাকলেও কোয়াড না বলে মাল্টিকপ্টার বলছেন কেন?
উত্তর: কোয়াডকপ্টার, হেক্সাকপ্টার এগুলোকে এক নামে সিঙ্গলকপ্টারের সাপেক্ষে মাল্টিকপ্টার বা মাল্টিরোটর বলা হয়। কেউ চাইলে এটাকে কোয়াডকপ্টার বা কোয়াডরোটার ও বলতে পারে।
প্রশ্ন: রোবট আর ড্রোন নিয়ে চলছে মাতামাতি। শিক্ষক জীবনে ড্রোনের লড়াকু ব্যবহারের মাঝখানে উৎপাদনশীল ব্যবহারে আপনার আগ্রহ প্রবল। কীভাবে সেই স্বপ্ন বোনা শুরু করলেন?
উত্তর: আমরা যেসব ড্রোন নিয়ে কাজ করছি এগুলোর উৎপাদনশীল ব্যাবহারের সম্ভাবনা ব্যাপক। ব্যক্তিগতভাবে আমি এগুলোর উৎপাদনশীল ব্যবহারের দিকে মুখিয়ে আছি। উৎপাদন শুরু হলেই এগুলো কেবল মানুষের কাজে আসতে শুরু করবে। তবে এ মুহূর্তে আমি আমার সময় গবেষণাতে সীমায়িত রাখতে বেশি আগ্রহী। সোলারকপ্টার ছাড়াও আরো কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা করছি, সেগুলোকে এগিয়ে নিতে চাই।

প্রশ্ন: সোলারকপ্টারটির কি কোনো নাম দিয়েছেন?
উত্তর: বর্তমান ড্রোনটি আমাদের সোলারকপ্টার গবেষণার ধারাবাহিকতার ফল। ‘সোলারকপ্টার’ নামটা আমরা চালু করেছি। বর্তমান ড্রোনটিকে আমরা ‘মাইক্রো সোলারকপ্টার’ বলি। আলাদা কোনো নাম নেই।
প্রশ্ন: শুধুমাত্র সৌর শক্তি ব্যবহার করে চালিত ড্রোনটি কতক্ষণ উড়তে পারে..
উত্তর: ড্রোনটিতে একটি লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারি সংযুক্ত আছে। সোলার প্যানেলের মাধ্যমে চার্যিত ব্যাটারির শক্তি দিয়ে এটা পরিচালিত হয়। সংযুক্ত সোলার প্যানেল উড়ানোর সময় কিছুটা বাড়ায়। তা ১০ বা ১২ পার্সেন্ট পর্যন্ত হতে পারে। ব্যাটারি চার্য হতে ৬৮ ঘন্টা সময় লাগে। আছে। আমাদের উদ্ভাবিত সিস্টেমটি ১৫ মিটার উচ্চতায় উড়তে পারে। ভিডিওতে যেভাবে দেখা যাচ্ছে এটিকে বিভিন্ন দিকে চালিয়ে দেখানো হয়েছে। কোন একদিকে চালিয়ে দূরত্ব মাপা হয় নাই। বর্তমান সিস্টেমে আমরা সাধারণ আকারেরে একটি সোলার সেলও ব্যবহার করা হয়নি। একটি সোলার সেল থেকে লেজার দিয়ে কেটে তিনটা অংশ ব্যবহার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এ তিন অংশের পরিমান একটি সাধারণ সোলার সেলের অর্ধেকের সম পরিমানের কাছাকাছি।
প্রশ্ন: সোলার ড্রোন কি ব্যাটারির সাহায্য ছাড়াও শুধু সোলারে চলানো সম্ভব?
উত্তর: ২০১৩ সালে ব্যাটারি বা কোনো কম এনার্জি স্টোরেজ ছাড়া আমরা ৩৬টি সেল ব্যবহার করে আমাদের সোলারকপ্টার উড়াতে সক্ষম হই। সেটার মাধ্যমে প্রমান করা (প্রুফ অব কনসেপ্ট) সম্ভব হয়, যে কোন রকম ব্যাটারি ছাড়া কোয়াডরোটর ধরনের সিস্টেমের উড্ডয়ন সম্ভব। তবে তা শুধু অল্প সময়ের জন্য। আরো অনেক বেশি সোলার সেল ব্যবহার করলে শুধুমাত্র সোলার এনার্জি দিয়ে কোয়াডরোটার ধরনের সিস্টেম উড়ানো সম্ভব। তবে এই ড্রোনের মতো এত ক্ষুদ্র আকারের মাল্টিরোটর সিস্টেম বর্তমান প্রযুক্তিতে শুধু মাত্র সৌরশক্তি দিয়ে চালানো সম্ভব না। ভবিষ্যতে সূর্য থেকে শক্তি উৎপাদনে সোলার সেলের ক্ষমতা অনেক বাড়লে এত ক্ষুদ্র আকারের সিস্টেম শুধুমাত্র সৌরশক্তি দিয়ে চালানো সম্ভব হবে। আমাদের সে প্রচেষ্টা অব্যাহত।
প্রশ্ন: অন্ধকারে আপনার ড্রোনটি কি কাজ করতে সক্ষম?
উত্তর: জী। এ ড্রোনটির সাথে একটি লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারি যুক্ত আছে। সোলার প্যানেলের মাধ্যমে ব্যাটারিটি চার্যিত হয়। দিনে সূর্যের আলাতে চার্যিত ব্যাটারির শক্তি দিয়ে ড্রোনটিকে রাতে চালানো যাবে।
প্রশ্ন: ২০১২ সালে সোলারকপ্টার উদ্ভাবন করা হয়। আজ ২০২৪ সেই উদ্ভাবনকে কতটা এগিয়ে নিতে পেরেছেন? আগামী দশকে কোথায় যেতে পারে ড্রোনের ব্যবহার?
উত্তর: আমার আগের উত্তরগুলো থেকে অগ্রগতি কিছুটা হয়তো আঁচ করা গেছে। সেই ২০১২ সালের এক মিটার দৈর্ঘ্য প্রস্থের মালটিরোটর ড্রোনটি রূপান্তরের ধারায় এখন এই ক্ষুদ্র মাল্টিরোটর ড্রোন। ড্রোনের ব্যবহার বাড়ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে, বিশেষ করে বেসামরিক ক্ষেত্রে। আমাদের আগ্রহ এবং গবেষণা সোলার ড্রোনের শুধু বেসামরিক ব্যবহারে। নির্মাণ কাজ মনিটরিং, বনে-জঙ্গলে জীবজন্তুর চলাফেরা এবং বিপদ-আপদের ঝুঁকি মনিটরিং, আবহাওয়া মনিটরিং, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বন্যা এবং ভূমিকম্প কবলিত স্থানে ক্ষয়ক্ষতি এবং ত্রাণ কাজ মনিটরিংসহ নানাবিধ কাজে ড্রোনের ব্যবহার বাড়তেই থাকবে।
ড্রোন নিয়ে আমার গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। মল্টিরোটর ড্রোনের উৎকর্ষতা সাধনের পাশাপাশি আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো ছোট আকারের এবং ২৫ কেজির চেয়ে কম ভরের সোলার কোয়াড প্লেনের উদ্ভাবন। যেটা হেলিকপ্টারের মতো কম উচ্চতায় উড়বে এবং কোনো রানওয়ে ছাড়া হেলিকপ্টারের মতো ভার্টিকাল টেক অফ এবং ল্যান্ডিং করতে পারবে। তথ্য সংগ্রহ, ইন্সপেকশন বা পরিদর্শন এবং পর্যবেক্ষণসহ খুব কম ভরের জিনিস যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঔষধ পরিবহনের মতো ক্ষেত্রে এ ধরনের সিস্টেমের ব্যাপক ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রশ্ন: ড্রোন নিয়ে আপনার ভালোবাসা কিংবা তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকলে একটু শেয়ার করবেন।
উত্তর: ২০১৪ সালে দেশের একটি টিভি চ্যানেলের সোলোর ড্রোনের উপর নিউজে আমাকে দেখানো হয়। আমার ফ্যামিলি তখন দেশে। দেশে থেকে আসা একটি ফোন ধরলে ছোট মানুষের কন্ঠ শুনি, ‘বাবা, তুমি সোলারকপ্টার বানাইছো, আমি তোমাকে দেখছি।‘ আমার সাত বছরের ছোট মেয়ের কন্ঠ। ওর কন্ঠের এ কথাগুলো মাঝে মাঝে আমার কানে ভাসে।
ডিজিবাংলা: অনেক সময় ধরে প্রশ্নের জবাব দেয়ায় আপনাকে ধন্যবাদ।
হাসান শাহীদ: আপনাকে এবং যারা এতোক্ষণ ধৈর্য ধরে পড়লেন তাদের প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা।