বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি’র কার্য নির্বাহী কমিটির পদত্যাগের ১০ দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার দিবাগত গহীন রাতে একসঙ্গে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) ৫ সদস্য। রাত ১.২০ মিনিটে সদস্যদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এই তথ্য শেয়ার করেন সংগঠনটির ভাইস প্রেসিডেন্ট আম্বারিন রেজা।
তার ওই বার্তা অনুযায়ী, তিনি সহ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খন্দকার তাসফিন আলম, গভর্নমেন্ট অ্যাফেয়ার্স পরিচালক মোহাম্মদ ইলমুল হক সজীব, কমিউনিকেশন অ্যাফেয়ার্স পরিচালক মো. সাঈদুর রহমান ও কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স পরিচালক শাহরিয়ার হাসান পদত্যগ করেছেন।
ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানে বিতর্কিত অবস্থানের কারণে কিছু সদস্যের প্রতিবাদের মুখে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে গত ১৩ আগষ্ট ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সার পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি সাহাব উদ্দিন শিপন।
তাকে বরাবর লেখা ইলমুল হক সজীবের পদত্যাগ পত্র থেকে জানাগেছে, ঘোষণা ছাড়াই নির্বাচন বোর্ড পদত্যাগ করায় সময় মতো ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত না হওয়ার শঙ্কায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধরে রাখতে এই পদত্যাগ।
এ নিয়ে চিঠিতে তিনি লিখেছেন, গত ২৭ জুলাই ২০২৪ ই-ক্যাবের এক্সিকিউটিভ কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঐ সময়ে দেশে ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার জন্য নির্বাচনটি দ্রুত সম্পন্ন করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম যাতে ইন্ডাস্ট্রির তথা ই-ক্যাবের কার্যক্রম আরো গতিশীল হয়। তবে দুঃখজনক সংবাদ হলো, নির্বাচন উপলক্ষ্যে গঠিত নির্বাচনী বোর্ড এ ব্যপারে বর্তমান কমিটির সাথে কোন প্রকার আলোচনা ছাড়াই হঠাৎ তাদের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। যার ফলে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় সংগঠনের সাধারণ সদস্যদের মাঝে আমি এই বার্তা পৌছে দিতে চাই যে, আমি নির্ধারিত মেয়াদের থেকে অতিরিক্ত সময় দায়িত্ব পালন করতে ইচ্ছুক নই। তাই গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে আমি এই পত্র দ্বারা এক্সিকিউটিভ কমিটির পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম।

জানা গেছে, সংগঠনটি থেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে পদত্যাগ পত্র দিয়েছেন ই-ক্যাব পরিচালক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল, সাধারণ সম্পাদক নাসিমা আক্তার নিশা, অর্থসম্পাদক আসিফ আহনাফ এবং পরিচালক মোহাম্মদ অর্নব মোস্তফা। অর্থাৎ ১১ সদস্যের এই কমিটিতে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছাড়া বাকি ১০ সদস্যই পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন।
তবে এদের অধিকাংশকেই ফোন দিয়ে পাওয়া যয়ানি। তারা কখন কীভাবে পদত্যাগ করেছেন তা তাৎক্ষণিক নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পরে জানাগেছে, এদের মধ্যে ৯ জনই পদত্যাগ পত্র দিয়েছেন হোয়াটসঅ্যাপে। প্রথমে বৃহস্পতিবার সকালে দেশের বাইরে থেকে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হওয়ার কারণ দিখিয়ে পরিচালক পথ থেকে পদত্যাগের কথা জানান প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আব্দুল ওয়াহেদ তমাল। এরপর মধ্যরাতে হোয়াটসঅ্যাপে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে গ্রুপ কলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাহব উদ্দিন শিপনকে বিষয়টি অবহিত করেন আম্বারিন রেজা। এসময় ওই কলে আরো ৪জন ইসি সদস্য ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিপন জানিয়েছেন, ফেনী থেকে বন্যা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কাজ পরিচালনার সময় রাত ১২টার দিকে একে একে পদত্যাগপত্র আসতে থাকে। তবে কাজের মধ্যে থাকায় তা তাৎক্ষণিক দেখা হয়নি। পরে গ্রুপ কলে পদত্যাগের কথা জানতে পারেন। এখন সংগঠনের অস্তিত্ব ঠিক রাখতে রবিবার সেক্রেটারিয়েটের সঙ্গে বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে করণীয় ঠিক করবেন তিনি।
প্রসঙ্গত, গত ২৭ জুলাই-ক্যাব কার্যনির্বাহী কমিটির ২০২৪-২৬ মেয়াদের নির্বাচন হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সরকার কারফিউ ঘোষণা করায় ভোট স্থগিত করা হয়। নির্বাচনে ১১ পরিচালক পদে প্রার্থী ছিলেন ২৪ জন। এরমধ্যে পদত্যাগকারীরা অগ্রগামী প্যানেলের হয়ে প্রচার-প্রচারণা চালান। বাকিরা স্বতন্ত্র্য ছিলেন। কিন্তু দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ই-ক্যাব অফিসে সাধারণ প্রার্থীসহ কয়েকজন ই-ক্যাব সদস্যের ক্ষোভ প্রকাশের পর সংগঠনের কয়েকজন সদস্যের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও কার্যক্রম নিয়ে ঘোরতর আপত্তি তোলা হয়। এমন পরিস্থিতিতে ই-ক্যাব অফিস কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। এসময় বেশ কয়েকজনের পদত্যাগ চেয়েছিলো ক্ষুব্ধরা।
এভাবেই দেশের পরিস্থিতি নাজুক হওয়ায় সময় গড়াতে থাকে সময়ের নিয়মে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে প্রার্থীদের সরকার ঘনিষ্ঠদের কেউ কেউ বিপ্লবী মূর্তিতে আবির্ভূত হন। এমন পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের নির্বাচন বোর্ড পদত্যাগ। করে এই বোর্ডের অপর সদস্যরা হলেন- এফবিসিসিআই সাবেক পরিচালক মো. বখতিয়ার ও বিএনএনআরসি সিইও এএইচএম বজলুর রহমান।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, গভীর রাতের পদত্যাগের পেছনের ভূমিকা রেখেছেন সহ সভাপতি আম্বারিন রেজা। তিনি ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে বরিশাল-৬ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মরহুম সৈয়দ মাসুদ রেজা এবং বরিশাল জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আইরিন রেজার কন্যা।
পরিবর্তিত নতুন সময়ে দেশ যখন পুণর্গঠনের কাজ চলছে তখন নতুন নির্বাচন বোর্ড গঠন না করেই গভীর রাতে কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পদত্যাগ করার ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। কেননা এই কমিটির মেয়াদ কাল শেষ হবে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর। এ অবস্থায় ইসি ভেঙ্গে দেয়ার মতো ঘটনায় অনেকেই তাই শঙ্কা করছেন, বিশেষ অবস্থার কথা বিবেচনায় না নিয়ে এ ধরণের ‘হোয়াটসঅ্যাপ পদত্যাগ’ প্রতিবিপ্লবের শামিল। কেননা, যখন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হয়েও সংগঠনের কোনো কোনো ইসি’র রাজনৈতিক আচরণে সাধারণ সদস্যরা ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেছিলেন তখন তারা নির্বাচনের অজুহাতেই থিতু ছিলেন। এরপর তারাও সংস্কারের কাতারে নাম লিখিয়ে বিপ্লবী সাজছেন। এর ফলে নির্বাচিত সদস্যদের বদলে প্রশাসকের হাতে চলে যেতে পারে ই-ক্যাব। বন্যা দুর্গতদের জন্য সংগঠনের ব্যানারে যে ত্রাণ কার্যক্রম চলছিলো তাও ব্যাহত হতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিচিত অপর দুই সংগঠন আইএসপিএবি ও বেসিস এর নাম চলে এসেছে আলোচনায়। আইএসপিএবি সভাপতিসহ বর্তমান কমিটির ৪জন ইসি সদস্যের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও পৃষ্ঠপোষকতার বিস্তর অভিযোগ রয়েঠে। এ নিয়ে বিক্ষোভও করেছে সাধারণ সদস্যরা। এমন পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিক সংগঠনের রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণ পূর্বক এক্ষেত্রে সাংগঠনিক ও কাঠামোগত সংস্কারের দাবি খাত সংশ্লিষ্টদের।