দেশের ৬ কোটি নাগরিকের তথ্য ইন্টারনেট দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। এই তথ্য বিক্রিতে পতিত সরকার বিদেশী একটি কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলো। সরকারি ভাবেও বেসরকারি কোম্পানির কাছে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এভাবেই ডিজিটাল দুনিয়ায় তথ্যসুরক্ষা লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে ইন্টারনেটকে সবার জন্য মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি করেছে মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির সঙ্গে একমত হয়ে খাত সংশ্লিষ্টরা মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি এই প্রযুক্তি এবং ডেটা উন্মুক্ত রাখতে সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা উচিত বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটের সাগর-রুনি হলে অনুষ্ঠিত সেমিনারে এই দাবি জানানো হয়। ঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সভায় অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন প্রযুক্তি বিশ্লেষক ফাহিম মাশরুর, তানভীর হাসান জোহা, আইআইজেএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম, আইএসপিএবি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল কাইয়ুম রাশেদ, প্রতিযোগিতা কমিশনের সাবেক পরিচালক খালিদ আবু নাসের, এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ প্রমুখ।
বক্তব্যে আইআইজিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, ২০২৪ সালে এসে শিক্ষা ও চিকিৎসা অনেকাংশে ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের ৪র্থ ও ৫ম মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হলে ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার বিকল্প নেই। তাই এ নিয়ে এখন সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। সাফাই গাইতে নয় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ব্রডব্যান্ডের দাম কম। এই দাম আরো কমিয়ে আনতে এনটিটিএন ও ট্রান্সমিশন সবচেয়ে বড় বাধা। সরকার ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত অবকাঠামো দুইটি বেসরকারি এনটিটিএনের কাছে জিম্মি রয়েছে। পাচারকৃত টাকা ফেরত আনার মতো এটিও সরকারের কাছে ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে রাষ্ট্রকে দায়বদ্ধ করতে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র যেন এক্ষেত্রে ইন্টারফেয়ার না করে সে বিষয় গুরুত্বারোপ করেন ফাহিম মাশরুর। তিনি বলেন, ওটিটিকে বেক্সিমকোর মতো কোম্পানির জন্য অ্যাকসেস দেয়া যাচ্ছে না। একইভাবে এনটিটিএন-কে সরকারই মনোপোলি ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছে। বিভিন্ন লেয়ারের বাধা তুলে দিলে ইন্টারনেটের দাম ২৫ শতাংশ কমে যাবে। তবে ইন্টারনেটের দাম কমাতে এবং নাগরিকের তথ্য সুরক্ষায় ‘ফোন ট্যাপ’ এর নিয়ম-কানুনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন তিনি। একইভাবে এনটিএমসি এখনো বিলুপ্ত না হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেন ফাহিম মাশরুর।
দর্শক সারি থেকে অংশ নিয়ে খুব শিগগিরই ইন্টারনেট ও মোবাইলের কল চার্জ কমবে বলে জানান রাষ্ট্রচিন্তা ও টিপ্যাপ সদস্য দিদারুল আলম। তিনি বলেন, সংবিধান সম্মত উপায়েই দেশে জুলুম হয়। তাই এর ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করতে হবে। নগর ও নাগরিকদের জিম্মি করে এখন আন্দোলন বন্ধ রাখতে হবে। কেননা তৃতীয় পক্ষ এখন খুবই ক্রিয়াশীল। তাই সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
ইন্টারনেট ব্যবসাটি প্রফেশনাল করার আহ্বান জানিয়ে প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেছেন, যে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই আর্টিকেল ৭০ মাইন্ডসেটে রয়েছে। তাই ১৫ দিন ইন্টারনেট বন্ধ করে ১০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এতে সরকারের কিছু যায় না। তাই জালাল উদ্দিন রুমীর ভাষায় ‘চালাক’ ছিলাম থেকে ’বুদ্ধিমান’ হওয়া দরকার। প্রযুক্তির ভাষায় নয় রাজনৈতিক ভাষায় কথা বলতে শিখতে হবে। তাই সংবিধানের এই আটিকেল নিয়ে সিরিয়াসলি আলোচনা হওয়া দরকার। ইন্টারনেট মাইন্ডসেটের লড়াই। এই ব্যবসায় চাঁদাবাজ ও রাজনৈতিক ল্যাসপেন্সাররা জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে একাট্টা হতে হবে।
‘সংবিধানে ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার ও ডাটা সুরক্ষা অন্তর্ভুক্তি’ শীর্ষক নাগরিক ভাবনা প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, ইন্টারনেটে মৌলিক অধিকার দেওয়ার যে প্রস্তাব এসেছে, সেটার সঙ্গে আমি একমত। যে কারণে আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে। যে কারণে এই প্রজন্ম ফার্মের মুরগি তকমা ছাড়িয়ে রাজপথে নেমেছে। সেই মাধ্যমটাকে ছোট করার কোন সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দলের পয়সা উৎপাদনের কিছু ক্ষেত্রে। এর মধ্যে রয়েছি ইন্টারনেটের ব্যবসা ও ডিসের ব্যবসা। এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা দাবি করছি এই ব্যবসাগুলোকে কর্পোরেট করে ফেলার। কারণ এখান থেকে রাজনৈতিক দলের নেতারা কোটি কোটি টাকা আয় করেন।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদের (খ) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে। এখানে লক্ষণীয় যে, বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের সাথে সাথে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতারক হ্যাকার ও স্ক্যামার চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে নাগরিকের তথ্য বেহাত করে যেমন ভাবে সর্বশান্ত করছে। আবার অন্যদিকে বেসরকারি বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিকের তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে ব্যর্থ হয়েছে। যেহেতু বর্তমানে চিঠি আদান-প্রদান এর মাধ্যম আর নেই, তাই ইমেইল হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা প্রযুক্তির অন্যান্য সকল মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে এমনকি সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে নাগরিকের প্রদেয় তথ্য সুরক্ষিত রাখতে সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল বিন্যাসে নাগরিকের ডাটা সুরক্ষা অন্তর্ভুক্তি উল্লেখ থাকা অতি আবশ্যক বলে আমরা মনে করছি।