সাইবার সুরক্ষা আইন হালনাগাদ করা হচ্ছে জানিয়ে গোলটেবিল আলোচনায় মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে ‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না নীতি গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তথ্যপ্রযুক্তি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী। তিনি বলেন, সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বড় ইস্যু। আইনের ভাষায় নেতিবাচক কিছু আছে কি না সেটা দেখতে হবে। আইন নিবর্তন মূলক হওয়া যাবে না। সেলসেন্সরশিপ মানে এমন নয় যেন যা বলার কথা তা আমরা বলছি না।
সাইবার সুরক্ষায় করণীয় বিষয়ে সচিব বলেন, ৩৬ আগষ্টের বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা বাক-স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি। একে অর্থবহ করতে আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। আমার দফতর থেকে মাত্র তিন-চার জন ব্যক্তি দিয়ে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ (এনসিএসএ) চলছে। অথচ একে আরো শক্তিশালী করা দরকার। একইসঙ্গে নাগরিকদের নিয়ে বেশি বেশি নাগরিক সংলাপ করতে চাই। সব পক্ষের মত নিয়েই এই আইন সংশোধন করা হবে।
মঙ্গলবার রাজধানীর ব্রাক সেন্টার ইন-এ টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে অপর মুখ্য আলোচক বিটিআরসি চেয়ারম্যান এমদাদ উল বারী বলেন, ডেটা সুরক্ষা ও তথ্য শেয়ারিং এর ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা সহজ নয়। এরমধ্যে রয়েছে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ভেদের দ্বন্দ্ব। এর মধ্যে সবচেয় বড় চ্যালেঞ্জ বাক-স্বাধীনতায় ভারসাম্য রক্ষা। সংস্কৃতি, জাতিয়তার সীমার মধ্যে যদি আমরা দূরত্ব কমাতে পারি তাহলে সমাধান সহজ হবে। এই সমাধানটা নিজেদের মতো করে ‘সেলােই’ করতে হবে। ডিজিটাল অপরাধ সনাক্তের জন্য আইন করতে হবে। কোন প্রযুক্তি আমরা কীভাবে ব্যবহার করবো সে জন্য আগাম চিন্তা করে আগামীতে কোন মূল্যবোধ নিয়ে চলবো, কতটুকু যন্ত্রের ওপর নির্ভর করবো তা নির্ধারণ করতে পারবো।
বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, বন্যায় নদীর পানি যখন পথ-ঘাট-ক্ষেত একাকার করে। তখন শুধু চিনি উঁচু ঘর-বাড়ি। ইন্টারনেট প্রটোকল যখন আসে তখন বন্যার মতোই সবাইকে ভাসিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এখন আমরা ডাঙার ঘটনার বিষয়টি জলের ওপর আঁকি-বুকি করছি। তাই আমাদের আগে ভাবতে হবে আমরা কি আর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চাই না সুরক্ষা চাই। কিন্তু সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার করতে গেলে সুরক্ষায় ছাড় দিতে হয়। তাই রেগুলেশনের পাশাপাশি ইনসেন্টিভ দিতে হবে। এতে একাডেমিকে এর সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব হবে না।
কগনেটিভ ও টেকনোলজি দুইটি ডোমেইনির ওপর সাইবার নিরাপত্তা নির্ভর করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুঃখজনক হলো এই দুয়ের মধ্যে শুন্যতা রয়েছে। এটি আমরা নির্দিষ্ট করছি না। থ্রিজি আনার সময় এক পক্ষ নিরাপত্তা দিতে না পারার কারণে মত দেয়া হয়েছিলো। আবার ব্যাবসায়ীরা প্রবৃদ্ধি করেছিলেন। কোনো যুক্তিই অমূলক নয়। তাই এই দুইয়ের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তা বের করতে হবে।
টুকরো-টুকরো নেটের সমন্বিত ‘ইন্টারনেট’ সুরক্ষিত করতে হলে সবাইকে নিয়ে টপডাউন কো-অর্ডিনেশন ও বটম আপ কলাবরেশনের যেতে হবে। একইভাবে আইসিটি ও টেলিকম একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হতে হবে। কেন্দ্রীয় সমন্বয় না থাকায় বিগত সময়ে ভেন্ডরদের পরামর্শে কাজ হয়েছে। এতে বড় শুন্যতা তৈরি হয়েছে- যোগ করেন তিনি।
বারী বলেন, সড়কে সুশৃঙ্খলায় ২০০৪ সালে জাইকার একটি প্রকল্পে রিক্সা উঠিয়ে দেয়ার যে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছিলো তা দুই দিনও টেকেনি। গ্লোবাল সাইবার সিকিউরিটি এজেন্ডার আলোকে ২০১৪ সালে আইসিটি বিভাগ ৫টি পিলারের মধ্যে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন তৈরি করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে স্পর্শকাতর তথ্য পরিকাঠামো কিভাবে নির্ধারণ করা হলো তা বোধগম্য নয়। আইসিটি টাওয়ারের মতো ছোট পরিসরে থেকে তথ্যপরিকাঠামোর সুরক্ষা কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখতে হবে।
সগঠনের সভাপতি সমীর কুমার দে’র সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের নিরাপত্তা ও বাক স্বাধীনতার ভারসাম্য নিয়ে একটি উপস্থাপনা দেন টিআরএনবি’র প্রাক্তন সভাপতি রাশেদ মেহেদী।
আলোচনায় তিনি বলেন, আমেরিকার জন্য নাগরিক নজরদারির অন্যতম অনুষজ্ঞ ফেসবুক। যে ডিভাইস ও ব্রাউজার ব্যবহার করি তাও আমেরিকার। তাই এটিকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বলার সুযোগ নেই। আবার সব ধরনের বড় সিডিএন এখন এই দেশটিতেই। তাই বিশ্বজুড়েই চলছে ডেটা যুদ্ধ। তাই ক্লাউড, সার্ভিলেন্স সহ ডেটার ব্যাবসায় শতভাগ বাংলাদেশী মালিকানা থাকতে হবে।
সাইবারের পরবর্তী ধাপ মেটাভার্স। অপরাধ কখনো স্পেসের ওপর ভিত্তি করে না। তারপরও ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০১৮ সালে ডিজিটাল আইন নামে ৩২ ও ৫৭ ধারা যুক্ত করে নষ্ট করা হয়। এরপর ২০২৩ সালে সাইবার নিরাপত্তা আইনটিতে ৪৩ ধারাকে ৪২ ধারায় রূপান্তর করা হয়। জেল উঠিয়ে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এতে ই-লেনদেনে জালিয়াতি উৎসাহিত হতে পারে।
মূল আলোচনার ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহেমদ সাবির বলেন, স্পেস ভিত্তিক অপরাধের জন্য বিচার করাকে আমি অযৌক্তিক মনে করি। অপরাধকে অপারাধের গুরুত্ব ও প্রভাবের মাত্রা অনুযায়ীই বিচার হওয়া দরকার। আসলে নতুন মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণের সক্ষমতা আমাদের দরকার। রাষ্ট্রীয় ভাবে তথ্যের নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আইন করে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। ক্রসর্ডার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের বৈশ্বিক জোটগুলোর সঙ্গে যুথবদ্ধতা বাড়াতে হবে। নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন পূরণে বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে প্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
রবি’র কোম্পানি সচিব ব্যারিস্টার সাহেদ আলম বলেন, আইনের ছাত্র হিসেবে আমি বুঝি আমাদের দেশে ডিজিটাল ডোমেইন অবকাঠামো বলে কিছু নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৬০টি ধারারর মধ্যে ৩৭টি ধারাই ছিলো অপরাধ চিহ্নিত করার জন্য। এতে ১৮টি অপরাধ গণ্য করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ বৈশ্বিক সাইবার অপরাধের দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে আছে। তবে ই-গভর্নেন্সে আমরা পিছিয়ে আছি। তাই আমাদের কিসের জন্য কোন আইন দরকার তা আগে নির্ধারণ করতে হবে। আমার মনে হয়, বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করার কিছু নেই। তাই এটি পুরোপুরি বাতিল করে নতুন করে করা উচিত। ডিজিটাল ইকোনোমি যুক্ত করে টেলিকম আইনটিও হালনাগাদ বা নতুন করে করা দরকার।
বেসিস সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, বাকস্বাধীনতায় ভারসাম্য রক্ষায় সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য স্কুল থেকেই গঠনমূলক সমালোচনা করার সচেতনতা খুবই প্রয়োজন। এভাবেই সেলফ সেন্সরশিপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর পাশাপাশি ডিজিটাল ফরেনসিক কীভাবে ও কতটুকু পর্যন্ত আদালতে গ্রহণযোগ্য সেদিকে নজর দিতে হবে। আমাদের দেশে ডেটা প্রাইভেসি না থাকায় আমাদের ব্যবসাও হুমকির মুখে পড়বে। তাই সবার আগে সেন্সেভিটির ওপর ভিত্তি করে ডেটা ক্যাটাগারাইজেশন করা দরকার। একইসঙ্গে আমরা নাগরিককে কতটা সার্ভিলেন্সে আনতে পারি, লিগ্যাল ইন্টারসেপশন করতে পারি সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েই আইন করতে হবে। তা না হলে মানুষ আইন ভাঙতে চেষ্টা করবে। তাই আইন তৈরির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।