ইন্টারনেটের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দিয়ে ভবিষ্যতে ইন্টারনেট বন্ধ করা চলবে না মর্মে ১০ দফা দাবি দিয়েছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন। দাবির মধ্যে বিটিআরসিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে মধ্যস্বত্বভোগী লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বাতিল, দলীয়করণ নয় মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তি সেবা খাতে নিয়োগ এবং টারনেটের মাধ্যমে ওটিটি-তে লাইভে টেলিভিশন এবং বিনোদন দেখতে দেওয়ার সুযোগ দাবি করা হয়েছে।
এছাড়াও বিটিআরসির চেয়ারম্যান এবং কমিশনারদের আইনের আওতায় এনে সিন্ডিকেট, দুষ্টুচক্র এবং দুর্নীতির সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে দ্রুত অপসারণ করে আইনের আওতায় আনার দাবিও রয়েছে দশ দফায়।
মঙ্গলবার দুপুরে ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে (ক্রাব) আয়োজিত ‘ইন্টারনেট বন্ধের কারণ ও বিটিআরসি দুর্নীতি-অনিয়ম’ সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি উপস্থাপন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, ইন্টারনেট বন্ধ করার পর দুইটি টিভি-তে সবার আগে খাজা টাওয়ারে অগ্নি সংযোগের ফলে ইন্টারনেট সরবরাহ বন্ধ হয়েছে বলে জানিয়ে ছিলেন আইএসপিএবি সভাপতি। কিছুক্ষণ পরে ব্যান্ডউউথ না পাওয়ার কথা জানান তিনি। তখন বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি তাকে ফোন দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন তারা সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথ তৈরি করছেন কিনা। এরপর তৎকালীন প্রতিমন্ত্রীকে ইন্টারনেট বন্ধ না করার জন্য অনুরোধ করা হলেও তা শোনা হয়নি বলে ক্ষুব্ধ প্রকাশ করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গতমাসের ১৬ এবং ১৭ জুলাই রাজধানীর কিছু অঞ্চলে সীমিত পরিসরে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ হলেও ১৮ জুলাই থেকে সারা দেশে একযোগে মোবাইল ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। মোবাইলের ভয়েস কল ও মেসেজ সচল থাকলেও আন্তর্জাতিক কোনো মেসেজ দেওয়া যায়নি। আর ইন্টারনেট বন্ধের যুক্তি হিসেবে তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বিভ্রান্তিমূলক ও হাস্যকর বক্তব্য দিয়ে জাতির সঙ্গে পরিহাস করেছেন। এমনকি আইএসপিএবি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা গত ১৯ জুলাই প্রতিমন্ত্রীকে ইন্টারনেট চালু করার জন্য অনুরোধ করে ফোন করেছিলাম। তিনি আমার কথা না শুনেই ফোন রেখে দেন। পরে ২৭ জুলাই আমাদের একটি টিম খাজা টাওয়ার পরিদর্শন করে দেখতে পায় সেখানে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আসলে খাজা টাওয়ারের ডাটা সেন্টারকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ সার্ভার লকার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখান থেকে কোনো ইন্টারনেট সরবরাহ করা হয় না। তবে এখানে অবস্থিত কয়েকটি আইআইজি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করে।
তিনি বলেন, দেশে ইন্টারনেটের জোগান দিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইটিসি (ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্টোরিয়াল ক্যাবল) ভারত থেকে স্থল পথ দিয়ে ২৫০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ আমদানি করে। আর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিএসসিপিএলসি সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে সিমিইউ-৪ এবং সিমিইউ-৫ দিয়ে আরও ২৫০০ থেকে ৩০০০ এর মত জিবিপিএস আমদানি করে থাকে। ইন্টারনেট সেবার জন্য এই ব্যান্ডউইথ এবং ক্যাশ দুটিই গুরুত্বপূর্ণ।
ইন্টারনেট বন্ধের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সেসময় সরকারের নির্দেশে এনটিএমসির দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়া ব্যান্ডউইথ সরবরাহের মূল জায়গাটি বন্ধ করে দেন। অন্যদিকে মোবাইল অপারেটর এবং আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলিকে ক্যাশ সার্ভার বন্ধ করে রাখার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। ফলে মোবাইল অপারেটর, আইআইজি, আইএসপি সবাই নিরুপায় হয়ে যায়। দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি এই সব ঘটনা জানে। তারাও ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখার জন্য সহযোগিতা করেছে। এমনকি মোবাইলে অপারেটর আইআইজি আইএসপিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বিটিআরসি থেকে। এমনকি মোবাইল অপারেটরদেরকে বিভিন্ন ধরনের ভীতিকর খুদেবার্তা গ্রাহকদের পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে বাধ্য হয়ে একমাত্র গ্রামীণফোন দেশের কয়েকটি অঞ্চলের গ্রাহকদের এসব খুদে বার্তা পাঠালেও রবি এবং বাংলালিংক খুদে বার্তা পাঠানো থেকে বিরত থাকে। সেজন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখার দায় তৎকালীন সরকার, এনটিএমসি, বিটিআরসি এবং বিএসসিপিএলসিকে নিতে হবে।
এসময় প্রতিযোগিতা কমিশনের সাবেক পরিচালক আবু খালেদ নাসের, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর জোহা, অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান শ্বাসত মুনীর, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান, প্রকৌশলী আবু সালেহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এদের মধ্যে প্রতিযোগিতা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান খালিদ আবু নাসের বলেন, ওটিটি ব্যবসাকে বন্ধ করে আকাশ এবং সেট টপ ব্যবসা শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছে। যা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিযোগিতা কমিশন আইনের লঙ্ঘন। তিনি এ ব্যাপারে প্রতিযোগিতা কমিশনকে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভির হাসান জোহা বলেন, গুজব যেমন আগেও হয়েছে এখনও হচ্ছে। বর্তমান সরকারের উচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফ্যাক্ট চেক করা। যাতে করে প্রকৃত তথ্য জানা এবং বোঝা যায়। সাইবার নিরাপত্তার চরম হুমকিতে আছে বাংলাদেশ। তাই দ্রুত সাইবার নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দাবি জানান।