এবারের বিশ্ব মঞ্চে উড়লো লাল-সবুজের পতকা বাহী দুটি বট। সভ্যতার চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা প্রকৃতির দূষণ রোধে এই বট দুটি উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিয়েছে দুই কন্যা। এদের একজন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজের শিক্ষার্থী আফিয়া হুমায়রা। অন্যজন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া আনজুম পুষ্প। এই দুই রোবো কন্যার হাতেই এবছর বিশ্বমঞ্চে উড়েছে লাল-সবুজের পতাকা।
তুরস্কের পশ্চিম সীমান্তের মহানগর খ্যাত ইজমিরে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াডের (ডিব্লিউআরও) ২১তম আসরে অংশ নিয়েছিলো বাংলাদেশের চারটি দল। আসরের রোবো মিশনে দেশের জন্য এক জোড়া ব্রোঞ্জ জিতেছে সাইবার স্কোয়াড ও চেইঞ্জ মেকার্স ২০২৪। জুনিয়ার বিভাগে বিশ্বের ৪৫টি দলের মধ্যে সাইবার স্কোয়াড রয়েছে ১৯তম অবস্থানে। আর সিনিয়র গ্রুপে ৪৮টি দলের মধ্যে চেইঞ্জ মেকার্স রয়েছে ৩৭ তম অবস্থানে। বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক এর সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান। মেন্টর হিসেবে ছিলেন মাহেরুল আজম কোরেশী।
অ্যাকুয়া মাস্টার
বন্যাকবলিত এলকায় উদ্ধার কাজের জন্য সাইবার স্কোয়াড তৈরি করে দেড় ফুট আকারের দ্বিতল নৌ-বট ‘অ্যাকুয়া মাস্টার’। তাদর উদ্ভাবিত রোবটটির বিল্ট ইন ক্যামেরা বন্যার সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখতে সক্ষম। এটি জিপিএস এবং ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে পরিচালনা করা যায়। প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে যেন উল্টে না যায় সেজন্য এতে ব্যবহার করা হয়েছে স্টেবিলাইজ ট্যাঙ্ক। রোবটটিতে প্রোপেইলারের পরিবর্তে রয়েছে ইম্পাইলার। ফলে পেছন দিকে পানির ধাক্কায় সামনে ছুটে চলে নৌ-বট। একইসঙ্গে স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় রোবটটি এর এমার্জেন্সি চেম্বার থেকে শুকনা খাবার, কাপড়, ঔষধ, পানযোগ্য পানিসহ প্রযোজনীয় জিনিসপত্র যোগান দিতে সক্ষম।
ব্রোঞ্জ পদক জয়ী এই স্বচালিত জলযানটি’র রূপকার বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজের দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আফিয়া হুমায়রা। উদ্ভাবনে তার সতীর্থ ছিলেন ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ওমেরা ফিদান এবং এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজের ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী নুজহাত জাহান। হুমায়রা-ওমেরা-নুজহাত- এই তিন কন্যার এটাই প্রথম বিশ্বমঞ্চে ওঠা। এই মঞ্চে ওঠার আগে বাংলাদেশ পর্বে এ বছরেই স্বর্ণ পদক জয় করে তারা। উত্তীর্ণ হয় নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জের বৈশ্বিক আসরে। আগের বছর আঞ্চিলিক পর্যায়ে লাভ করে জাতীয় শিশু পুরস্কার।
হুমায়রা জানান, সফরের সঙ্গী হিসেবে অভিভাবকদের ভিতর থেকে নুজহাত জাহান এর বাবা ছিলেন। বিমান খরচের বাইরে সফরের খরচ তাদের অভিভাবকরাই বহন করেছে। এছাড়া স্কুল থেকে ৫০ হাজার টাকার অনুদান দেয়া হয়। তিনি বলেন, আমাদের প্রোটোটাইপটি বাস্তবে তৈরি করতে ৩৮৮ মার্কিন ডলারের মতো খরচ হবে।
ওয়েভ সেইভার
প্রতিযোগিতায় বোঞ্জজয়ী বাংলাদেশের ‘ওয়েভ সেইভার’ একটি ভাসমান রোবট। আর নিরবিচ্ছিন্ন জ্বালানী শক্তির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে পরিবেশ বান্ধব সৌরশক্তি। নদী বা সমুদ্রে পানি থেকে তেল-দূষণ রোধ করতে কাজ করতে সক্ষত স্বয়ংক্রিয় এবং সৌরশক্তি চালিত রোবটটি। এ জন্য এর ক্যামেরার চোখ ইমেজ প্রসেসিং করে পানিতে থাকা তেল সনাক্ত করে। একইসঙ্গে বিশেষ প্রক্রিয়ায় চারপাশে বৃত্তাকার বাউন্ডারি তৈরি করে তা ছড়িয়ে পড়া ঠোকায়। রোবটটির ইমেজ প্রসেসিংয়ের কাজটি করেছে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের রাগিব ইয়াসার রহমান। থ্রিডি মডেল তৈরিতে সঙ্গী ছিলো সরকারি মদন মোহন কলেজের বি এম হামীম। বিজয়ী রোবট বিষয়ে দলনেতা পুষ্প বললেন, আমাদের ওয়েভ সেভার রোবটটি যেহেতু তেল ছড়াতে না দিয়ে বরং সংরক্ষণ করে। ফলে এটি ব্যবহারে একদিকে যেমন সামুদ্রিক প্রাণীদের জীবন রক্ষা পাবে; অন্যদিকে সংগৃহীত তেল পুর্নব্যবহার করা যাবে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া আনজুম পুষ্প’র তত্ত্ববধানে বট-বোটটি তৈরির সঙ্গী ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের রাগিব ইয়াসার রহমান এবং সরকারি মদন মোহন কলেজের বি এম হামীম।
এই উদ্ভাবন নিয়ে রোবো উদ্ভাবক পুষ্প বললো, নরমালি প্রতিবছর ১.৩ মিলিয়ন টন তেল পানি দূষিত করে যা পরিষ্কার করতে প্রতি লিটারে ১৬ হাজার ডলার খরচ হয়। শুধু তাই না, ২৫ হাজার সামুদ্রিক প্রজাতি এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের WaveSaver রোবটটি যেহেতু তেলকে ছড়াতে দেয় না, তাই সামুদ্রিক প্রাণীদের জীবন রক্ষা পাবে। এটির সংগ্রহকৃত তেল পুর্নব্যবহার করা যাবে এবং এটি যথেষ্ট cost efficient। এটি বাস্তবে বানাতে খরচ হবে ২১১৫ মার্কিন ডলার।
গত ২৮ নভেম্বর-৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াড (ডব্লিউআরও) ২০২৪। সিনিয়র সেশনের এই প্রতিযোগিতার মূল প্রতিপাদ্য ছিলো ফোর্স অব নেচার। তাদের সঙ্গে প্রযুক্তির শক্তিতে প্রকৃতির ক্ষতি কমাতে রোবটের উদ্ভাবনী ব্যবহার দেখাতে গেমিং ঘরনার প্রতিযোগিতাটিতে অংশ নেয় বিশ্বের ৮৭টি দেশের ৫৬০টি রোবট দল। এছাড়াও ৫৭টি দেশ থেকে ১৯৭ জন বিচারকসহ মোট অংশগ্রহণকারী ছিলো ৩১৫০ জন। এরমধ্যে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক পর্বের বিচারক হিসেবে যুক্ত ছিলেন সাজ্জাদ ইসলাম, রেদওয়ান ফেরদৌস এবং সিহাব সারার আহমেদ।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটিতে ‘ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াড ২০২৪’ বাংলাদেশ এর জাতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পর্যায়ে বিজয়ীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক দল নির্বাচনী ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। এই ক্যাম্পের সাফল্য এবং পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে ‘ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াড ২০২৪’-এ বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্বকারী দল নির্বাচন করে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক।