নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা সরিয়েছেন জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের চেয়ারম্যান আদনান ইমাম। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সহায়তায় এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো গত ২০ নভেম্বর এক চিঠিতে তিনি এ অভিযোগ করেছেন ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান শরীফ জহির।
সেখানে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই সময়ে পূর্ববর্তী পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদকালে ব্যাংকটিতে গুরুতর অনিয়ম ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে উল্লেখ করে এই অভিযোগ করেছেন তিনি। চিঠিটি ডিজিবাংলা’র হাতে রয়েছে।
চিঠির ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের শেষের দিকে আগের পর্ষদের অনুমোদনক্রমে আমের রাসূল ও জাহারা রাসূলের কাছ থেকে জেনেক্স ইনফোসিসের ৬০.৫৪ লাখ লকড-ইন শেয়ার কেনে ইউসিবি। এই শেয়ার ক্রয় থেকে প্রায় ৭৮ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ইউসিবি। এই শেয়ারের বিক্রেতা আমের ও জাহারা রাসূল ম্যানেজমেন্টকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি তৎকালীন পর্ষদ চেয়ারম্যানের কাছে তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছিলেন। তৎকালীন পর্ষদ স্বতন্ত্রভাবে তাদের প্রস্তাব রিভিউ ও অনুমোদন করে। আদনান ইমাম জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেড-এর (জেনেক্সিল) চেয়ারম্যান এবং শেয়ার বিক্রেতা আমের রাসূল ও জাহারা রাসূল যথাক্রমে আদনান ইমামের শ্যালক ও বোন। শেয়ার ক্রয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জহির বলেন, লেনদেন ত্বরান্বিত করতে ব্যাংকের তৎকালীন নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান ও আদনান ‘অন্যায় প্রভাব’ খাটিয়েছিলেন।
চিঠতে লেখা হয়েছে, আদনান ইমাম তার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান, যেমন ‘জেনেক্স ইনফোসিস, জেনেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার, এ অ্যান্ড পি ভেঞ্চার, এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্টস ও এডব্লিউআর রিয়েল এস্টেটকে ব্যবহার করে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর চাচাতো ভাই আলমগীর কবীর অপুর সহায়তায় নিয়মবহির্ভূতভাবে এসব ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করিয়েছেন।
জহির দাবি করেন, ইউসিবির পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক বা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কোনো আইনি অধিকার না থাকা সত্ত্বেও সাইফুজ্জামানের প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কার্যত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হয়ে উঠেছিলেন। এসব অনিয়ম সংঘটনের জন্য সাইফুজ্জামানের স্ত্রী রুকমিলা জামানকে পর্ষদ চেয়ারম্যান এবং ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরীকে নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
দুদককে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, আলমগীরকে দ্রুত ঊর্ধ্বতন পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তারপর এসব ঋণ অনুমোদনের জন্য তাকে কর্পোরেট ব্যাংকিংয়ের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
চিঠিতে জহির আনুষ্ঠানিকভাবে দুদকের সাবেক পর্ষদ সদস্যদের অনিয়ম তদন্তের অনুরোধ জানিয়ে জহির বলেন, এসব প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে। ব্যক্তিগত লাভের জন্য অনিয়মিত ঋণ অনুমোদনসহ অন্যান্য উপায়ে এসব কাজ সংঘটিত হয়েছিল। আগের পর্ষদের কারণে ইউসিবি বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
চিঠিতে আরো বলা হয়, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সাইফুজ্জামান চৌধুরী পর্ষদ সদস্যদের পদত্যাগে বাধ্য করেন। তারপর তার পরিবারের সদস্য ও সহযোগীদের তাদের জায়গায় বসান। এরপরই প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জগুলো শুরু হয়ে।
জহির অভিযোগ করেছেন, এই চুক্তিটি করা হয়েছিল ব্যক্তিগত লাভের জন্য। শেয়ার বিক্রেতা ও সাবেক পর্ষদ সদস্যদের মধ্যে সম্ভাব্য অবৈধ যোগসাজশের ইঙ্গিত দেন তিনি। একইসঙ্গে চিঠির সঙ্গে গত ৯ অক্টোবরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং ৪৬৪ ও ৪৬৫তম বোর্ড মিটিংয়ের কপি সংযুক্ত করে দিয়েছেন।
ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে এসব অনিয়মের সুষ্ঠু তদন্ত শুরু করে সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান, সাবেক পর্ষদ সদস্য, শেয়ার বিক্রেতা আমের ও জাহারা রাসূল, আদনান ও আলমগীরসহ সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুদককে অনুরোধ জানিয়েছেন জহির।
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বেশ কিছু পরিবর্তনের পর ২৯ আগস্ট শরীফ জহির ইউসিবির নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন শরীফ জহির।