দেশে বর্তমানে সাড়ে তিন লাখের মতো আইটি কর্মী রয়েছে। তাদের অধিকাংশ বিভিন্ন ডিজাইন বেইজড কাজ করে। কিন্তু সেবা ভিত্তিক হলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে। তাই মাইক্রোচিপ ডিজাইনের পাশাপাশি ডিভাইস ম্যানুফ্যাকচারিং ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা এবং আইওটি, এআই এর মতো বিষয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তা না হলে, প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে কর্মক্ষেত্রে আসছে তাদেরকে এই খাতে কাজে লাগানো যাবে না। কর্মসংস্থান বাড়াতে স্থানীয় বাজারকে বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে দিতে হবে। এজন্য নীতি পূনর্মূল্যায়ন, দক্ষতা অর্জনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য রফতানি বাড়ানো, নতুন প্রযুক্তি নির্ভর উদ্যোগ গ্রহণ, স্থানীয় বাজার প্রবৃ্দ্ধি এবং সুলভ অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে ই-সরকারের অটোমেশন বাস্তবায়নের পাশাপাশি দুনীতির টুটি চেপে ধরে প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশ বিশ্বে আইসিটি সেবার হাব হতে পারবে।
শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স (ডিসিসি) সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের প্রবৃদ্ধির জন্য করণীয় নিয়ে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ডিসিসিআই সভাপতি মোঃ আশরাফ আহমেদ।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কারের জন্য আইন বা নীতিমালা কোনো বাধা নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। তিনি বলেন, পলিসি বা আইন না বদলে কী করতে হবে, কাকে করতে হবে এবং কবের মধ্যে করতে হবে তা আমাকে একটি স্প্রেড শিটের মাধ্যমে পাঠান। আমি ডাটা ও ফ্যাক্টস নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। তাই এই খাতের প্রকৃত ফ্যাক্টস-ফিগারগুলো আমাকে দিন। আইন সংস্কার, দৈনন্দিন কাজ ও ব্যবসায় বাণিজ্য সহজীকরণের বিষয়গুলো মাল্টিস্টেক হোল্ডার ইস্যু। তাই এগুলো সাবাই মিলে সমাধান করা উচিত।
তিনি আরো বলেন, আইসিটি খাতের সংস্কারে খাত সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে, যুক্ত থাকতে হবে সংস্কার কমিশনের সাথে। কেননা অন্তর্বতী কালীন সরকার দীর্ঘ মেয়াদে চলতে পারে না। তাই যতদ্রুত সম্ভব জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে করতে আমরাও তিনটি বাকেটে সংস্কারের কাজ করছে সরকার। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সংস্কারের ক্ষেত্রে, আইন এবং নীতি কোন বাঁধা নয়; প্রয়োজনে সব পরিবর্তন করে দেশটাকে বদলাতে হবে।
আইসিটি বিভাগের উপদেষ্টা ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, পদ-পদবী বদল করা সংস্কার নয়। আর ব্যবসায়ীদেরও রাজনীতিতে আসা উচিত নয়।
সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিডা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মাদ জাকির হাসান। সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, সরকার আসবে সরকার যাবে আমাদের ব্যবসায় চালিয়ে যেতে হবে। তাই আমাদের আগামী ১০ বছরে কী চাই সে দিকটায় গুরুত্ব দেয়ার পাশাশপাশি আগামী বছরে কী চাই তার ওপরও গুরুত্বারোপ করতে হবে।
বিডা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, পোশাক শিল্পের পর শ্রম দক্ষ করে আইসিটিকে রফতানি খাত হিসেবে গড়ে তোলা দরকার। সেকারণে সেমিকন্ডাক্টর, এআই নিয়ে কাজ করতে হবে। দুর্নীতির মহামারি ঠেকাতে ডিজিটাইজেশনের কোনো বিকল্প নেই।
উপস্থানায় দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে বেসিস পরিচালক ও বন্ডস্টেইন টেকনোলজিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর শাহরুখ ইসলাম বলেন, আমরা বাতাস বেঁচি না। আমরা সেবা দেই। তাই আমাদের পণ্য দেখা যায় না। কিন্তু সফটওয়্যার ব্যবসায় ইকোসিস্টেমে প্রচুর ভ্যালু সৃষ্টি করে। বিশ্ববাজারে সফটওয়্যার বিক্রির জন্য বিদেশের মাটিতে অফিস খুলে দেয়ার সুবিধা দিতে হবে। গবেষণা প্রণোদনা এবং পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে।
আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, আইসিটি বিভাগের উপদেষ্টা ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, সাবেক বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির, ওয়ালটন ডিজিটেক ইন্ডাস্ট্রির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিয়াকত আলী, বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান প্রমুখ।
বক্তব্যে দেশের তথ্য প্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন উপাত্তের সমালোচনা করে সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, এটা বীরবলের কাক গোনার মতো। উপস্থাপিত বিভিন্ন উপত্ত ঠিক নেই। এগুলো নিজেদের মতো করে করা উচিত। এটা করা হলে আমরা পোশাক খাতের মতো কম মূল্যের কাজ করছি। কিন্তু আমরা যদি নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করি তবে এই রফতানি বাজার বাড়বে। এজন্য আমাদের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যৌথ অংশীদারিত্ব বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে সবুজ প্রযুক্তিতে।
তিনি আরো বলেন, অন্তর্বতী কালীন সরকার দীর্ঘ মেয়াদে চলতে পারে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে করতে তিনটি বাকেট নিয়ে কাজ করছে সরকার।
ভেঞ্চর ক্যাপিট্যাল কোম্পানিগুলোকে ইনসেন্টিভ এবং এক্সিট সুবিধা রাখলে দেশের স্টার্টআপ খাত বিকশিত হবে বলেও মত দেন তিনি। একইসঙ্গে নাগরিকের ব্যক্তিগত সুরক্ষার নামে ডেটা সুরক্ষা আইনটি যেনো ডেটার সম্ভাবনাকে কবরে না পাঠায় এবং দূর থেকে কেউ যেনো আমাদের পেস মেকারের মতো গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় বিকল করতে না পারে।
বক্তব্যে বাংলাদেশে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো কেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে না তার কারণ তুলে ধরেন লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, দেশে প্রতিযোগিতামূলক টেকসই নীতিমালা হলে বিনিয়োগ বাড়বে। রেয়াতি সুবিধা নয়, রুট কস্ট বেড়ে যাওয়ায় তারা বাংলাদেশে আসছে না। একইভাবে ক্রয় নীতিমালায় কান্ট্রি অরিজিন দেয়ায় আমাদের দেশে আইসিটি উৎপাদনের চেয়ে আমাদনী নির্ভরতা বাড়ছে।
তাইমুর রহমান বলেন, পলিসি পরিবর্তন করলে দেশের আইসিটি খাতের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা ডিজিটাল বৈষম্য দূর করতে নিয়মিত বিনিয়োগ করছি। আমরা লাইসেন্সের স্বাধীনতা চাই। শুধু ভয়েসের মধ্যে সীমাবদ্ধ হতে চাই না। কিন্তু আমরা ইন্টারনেট ছড়িয়ে দিতে অবদান রাখছি। কিন্তু কিছু হলেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। এটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। তাই এসব জায়গায় নজর দেয়া দরকার।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে আইসিটি খাতের অবাকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মাদ জাকির হাসান বলেন, শিল্পখাতের জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের দক্ষতা বিষয়ে ইন্ডাস্ট্রিগুলোকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরামর্শ দিতে হবে। একই সঙ্গে এই খাত থেকে মানি আউট ফ্লোর চেয়ে ইনফ্লো বেশি হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের আস্থার অভাব রয়েছে।