দেশে ইসরাইলি প্রযুুক্তির ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেই যথেচ্ছাচার ভাবে ব্যক্তির নাগরিক গোপনীয়তার অধিকার হরণ করা হচ্ছে। কী কী সফটওয়্যার ব্যবহার করে কে, কখন, কীভাবে তার গোপনতা উদোম করছে তাও তারা জানতে পারছেন না। ব্যক্তির গোপনতা সুরক্ষা ও তার ব্যক্তিগত তথ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় আইন ও নীতিমালা প্রণয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। একইসঙ্গে বিগত সময়ের ফাঁদ মুক্ত হতে অবিলম্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) এবং স্বাধীন কমিশন হিসেবে বিটিআরসি’কে ক্ষমতায়িত করতে টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর (ডট) বিলুপ্ত ঘোষণা ও ভিন্নমত দমন ও নাগরিক অধিকার দমনের জন্য দেশে গত কয়েক বছর কি কি ধরনের সফ্টওয়্যার ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে সেটির শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। পাশাপাশি আড়িপাততে হলে সরকার নয় রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসেবে উচ্চ আদালতের অনুমতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।
শনিবার সিভিল রিফর্ম গ্রুপ বাংলাদেশ ২.০ আয়োজিত প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী নাগরিক সংলাপে এসব কথা তুলে ধরেন বক্তারা। বেসিসের প্রাক্তন সভাপতি ফাহিম মাশরুরের সঞ্চালনায় ফাহিম মাশরুর এর সঞ্চালনায় নতুন বাংলাদেশে আড়িপাতা, গোপনীয়তার অধিকার ও বাক স্বাধীনতা বিষয়ক সংলাপে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা, জাহেদ উর রহমান, টিআরবি নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, সাংবাদিক গোলাম মুর্তজা, আশরাফ কায়সার, তথ্যপ্রযুক্তি সাংবাদিক জাকারিয়া স্বপন, রাজনীতিবিদ জুনায়েদ সাকি, সাইবার বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির, মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়শন সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বিএম মইনুল হোসেন, ব্যারিস্টার মিতি সানজানা, এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া, প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ফিদা হক, আইআইডি সিইও সাঈদ আহমেদ প্রমুখ।
এছাড়াও অনলাইনে সংযুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন অনুসন্ধানী প্রবাসী বাংলাদেশী সাংবাদিক ও বিশ্লেষক জুলকারনাইন সায়ের খান ও টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক সাবহানাজ রশীদ।
বক্তব্যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারনেশনালের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখার জামান বলেন, এনটিএমসি ও ডিওটি-র মতো সরকারি যেসকল অঙ্গ প্রতিষ্ঠান গত কয়েক বছর এই আড়িপাতার সাথে জড়িত ছিল তাদের সংস্কার করা বা নতুন লোক বসিয়ে কোনো সমাধান হবে নাI এই দুই প্রতিষ্ঠানকে বিলুপ্ত করতে হবে এখনইI জাতীয় নিরাপত্তার জন্য আড়িপাতার প্রয়োজনীতা থাকলে সেটির জন্য আলাদা কমিশন করে নতুন বিধিবিধান তৈরী করতে হবেI
তিনি বলেন এনটিএমসি ও ডট এর কোনো প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও বহুমত দমন এক নয়।
মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, আদালতের ঘাঁড়ে বন্দুক ব্যবহার করে গত কয়েক বছর অনেক মানবাধিকার হরণের ঘটনা ঘটেছেI অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ও আগের মতো অপ্রাসঙ্গিক ও দুর্বল মামলা এবং রিমান্ডে বিভিন্ন আসামির বক্তব্য মিডিয়ায় প্রকাশের প্রতিবাদ জানানI তিনি গত কয়েক বছর মিডিয়াতে বিভিন্ন ব্যক্তির কল রেকর্ড ফাঁসের ঘটনায় মিডিয়ার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেনI
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, তদন্ত ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে পুরো বিশ্বেই আড়ি পাতা হয়। সেটা নাগরিকের ওপর নয়। সেটাকে আইনগত আড়ি পাতা বলে। আইনগত আড়ি পাতা হলে কীভাবে হবে, তথ্য কার কাছে যাবে, কার অনুমতি লাগবে, এগুলোর নিয়মিত নিরীক্ষা হতে হবে। এনটিএমসি বা ডট বন্ধ করা হলে অন্য সংস্থাকে দিয়ে তখন আড়ি পাতার কাজ চলবে। তাই এগুলো বন্ধ না করে প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিকে বদলাতে হবে। দেশের কোনো আইন যদি আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড বা মানের সাথে না হয়, তাহলে তার পরিবর্তন করতে হবেI
গোলাম মর্তুজা বলেন, পেগাসাস সহ যেসব ইসরাইলি সার্ভিলেন্স প্রযুক্তি পণ্যগুলো কার নির্দেশনায়, কীভাবে, কী কী কেনা হয়েছে তা আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জানতে চাই। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সুরক্ষার নামে কীভাবে এগুলো ব্যবহার হয়েছে, কারা কারা ব্যবহার করেছে, কার কার ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করা হয়েছে তা জাতিকে জানাতে হবে। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি প্রযুক্তির মাধ্যমে আতঙ্কে থাকতে চাই না। ভারতীয় প্রযুক্তিবিদদের ওপর নির্ভর থাকতে চাই না। আরা বিগত সরকারের আমলের অপরাধীদের নামে হত্যা মামলা করে নয়; প্রকৃত অপরাধেই অপরাধীদের সনাক্ত করতে চাই।
ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, বাণিজ্যিক কারণে আমরা বৈধভাবে নজরদারির শিকার হচ্ছি। কিন্তু আমার প্রাগৈতিহাসিক যুগের আলোচনা করা হয়েছি। থট পুলিশিং চলছে। স্বৈরশাক হওয়ার সঙ্গে আড়িপাতার যোগশাজশ রয়েছে। তাই সাবাইকে এ নিয়ে সোচ্চার থাকতে হবে।
অন্যদিকে নাগরিক হিসেবে নিজেদের ব্যর্থতার শ্বেতপত্র প্রকাশ করে জাতির কাছে দুঃখ প্রকাশ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ।
আশরাফ কায়সার বলেন, সরকার পরিবর্তনের ২০ দিন পরও আমরা এখনো সিগন্যাল খোঁজে। বিরোধ তৈরি হয় বাড়াবাড়ি থেকে। বাংলাদেশের বাজেটের অতিরিক্ত অর্থ যেন দেশের বাইরে না যায়। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে NTMC এবং DOT এর বিলুপ্তি চাই। তারপর এই প্রতিষ্ঠানে লগ্নিকৃত অর্থ দেশের প্রাইমারি স্কুলে ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ করতে হবে। এই দেশে প্রতিক্রিয়া কমেছে। মানুষ অনেক সুশীল হয়েছে। একটি জাতীয় টেলিভিশনের একজন উপস্থাপিকা প্রশ্ন করেছিলেন ৭ তারিখে আমি ভোট দিতে যাবো কিনা। অথচ এই ব্যক্তিগত বিষয় কোনোভাবেই জন সম্মুখে জিজ্ঞাস করার মত বিষয় ছিল না। সেই উপস্থাপিকা এখন ডিবি হেফাজতে আছেন।
রাজনীতিক জুনাইদ সাকি বলেন, গেল ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিস্ট সরকার পুরো রাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যবহার করে মানুষের গোপনীয়তা আর ব্যাক্তিগত বিষয়ে প্রবেশ করেছে। কারা মানুষের ফোনে আড়ি পেতেছে, অন্যের গোপনীয় বিষয়ে প্রবেশ করেছে তাদের তথ্য আমরা জানতে চাই। বাংলাদেশ এখন যে সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে যেখান থেকে গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটবে, যেখানে জবাবদিহিতা থাকবে। তরুণরা সেটাকে রাষ্ট্রীয় লক্ষ্যে পরিণত করেছে। একটা কমিশন দরকার যেখানে বিভিন্ন অংশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়শন সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিটিআরসি লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এটি তো এম্নিতেই ডট হয়ে গেছে। তাই ডটকে বিটিআরসি’র অধীনে আনা হোক। অথচ প্রতিমন্ত্রী কমিশনকে মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে এসেছেন। তিনি অনেক হম্বিতম্বি করলেও সোশ্যাল মিডিয়াগুলো আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা মানছে না।
শুধু আইন নয় আদালতকেও রিফর্ম করতে হবে বলে মত দেন মোঃ তৈয়ব। এছাড়াও আইন প্রয়োগের আইন দরকার বলে মত দেন রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া।
প্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন বলেন ব্যাড অ্যাক্টর্সের বিরুদ্ধে শক্তিশালী পুলিশিংয়ের জন্য আড়িপাতা থাকবেই। তবে এই ডেটা নিয়ে আরেকজনকে ব্লাকমেইল করা বন্ধ থাকতে হবে। এর প্রাক্টিস ঘরে থেকেই শুরু করতে হবে। সরকারের কাছে আমার কোনো প্রত্যাশা নেই। আমি চাই আরেকটি গণ-অভ্যুত্থান করবে গণ-অভ্যুত্থানের তরুণেরা। এটি হবে প্রাইভেসি ২.০। পর্দা ফাঁকা থকলে ভিডিও করা যাবে না। হরহামেশা সেলফি তোলা যাবে না। সাবাইকে শপথ নিতে হবে মিথ্যা কথা বলবো না।