সাইবার নিরাপত্তা আইনের সংস্কারসহ গণমাধ্যম সংস্কারে ১৩ প্রস্তাব দিয়েছে ‘ফ্যাসিবাদমুক্ত গণমাধ্যম চাই’ প্লাটফর্ম। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘গণমাধ্যম সংস্কার প্রস্তাব: নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক সভায় এই প্রস্তাবনা দেয়া হয়। বাকি প্রস্তাবনাগুলো হলো- গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ; গণমাধ্যমে নৈতিকতা ও পেশাদারত্ব প্রতিষ্ঠা; সরকারি নিয়ন্ত্রণ রোধে স্বতন্ত্র গণমাধ্যম কমিশন গঠন; মালিকানা ও অর্থায়নের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ; সাংবাদিকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া ও চাকরির নিরাপত্তা; বেতন কাঠামোর সংস্কার; সাংবাদিকদের সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন; বাজেটে গণমাধ্যমের জন্য বরাদ্দ রাখা; গণমাধ্যম নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজীকরণ; আঞ্চলিক ও বিকল্প গণমাধ্যমের উন্নয়ন; তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণ এবং জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা।
ফ্যাসিবাদমুক্ত গণমাধ্যম চাই প্লাটফর্মের আহ্বায়ক জয়নাল আবেদীন শিশিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, কপিরাইট আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকায় ‘ফেইক নিউজ’ বা ভুয়া সংবাদের ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠছে। কারো দীর্ঘ পরিশ্রম দিয়ে করা প্রতিবেদন, ছবি আরেকজন এক সেকেন্ডে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। এতে মূল ধারার সাংবাদিকদের পারিশ্রমিক কমে যাচ্ছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে কপিরাইট (মেধাস্বত্ব) সুরক্ষা দেওয়া উচিত। কপিরাইট আইনের এনফোর্সমেন্ট (প্রয়োগ) খুবই জরুরি।
সব সাংবাদিককে এ বিষয়ে জোরালো কথা বলতে হবে। তিনি আরো বলেন, আপনি দুই মাস খেটে একটা প্রতিবেদন করলেন, সেই প্রতিবেদন এক সেকেন্ডে আরেকটা সংবাদ প্রতিষ্ঠান বা এক’শ প্রতিষ্ঠান চুরি করে ফেলল। আপনি সুন্দর ছবি তুললেন, বড় পত্রিকা বিনা অনুমতিতে ছাপিয়ে দিল। একটা ভালো প্রতিবেদন করলে একশ’টা প্রতিষ্ঠান চুরি করে। আপনাকে কপিরাইট প্রটেকশন (মেধাস্বত্ব সুরক্ষা) আমার দিতে হবে।
শফিকুল আলম বলেন, ‘দেশের প্রথম সারির একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান আরেকটি বিদেশি গণমাধ্যমের ১৩২০টি ছবি চুরি করেছে এক বছরে। যাচাই ছাড়া অনেকে যেখানে যা পান ছাপিয়ে দেন। সাংবাদিকতা এতো চিপ (সস্তা) কাজ নয়। ফেইক নিউজের (ভুয়া সংবাদ) বিষয়ে আইন আরও স্ট্রং (কঠোর) হওয়া উচিত। বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে ভুল সংবাদ ছাপলে জরিমানা করা হয়, এবং সেই জরিমানা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে বরাদ্দ অর্থ থাকে। গত বছর ২৫ মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ ছিল ডেইলি মেইলে।
কারও নামে আমরা ঘৃণা না ছড়াই। কাউকে শাস্তি দেওয়াও আমাদের উদ্দেশ্য নয়। গবেষণা করেন, যারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে বয়ান তৈরি করেছিলেন তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে চাই। এজন্য তখন তারা যে এডিটরিয়াল (সম্পাদকীয়) লিখেছেন, রিপোর্ট লিখেছেন, সেগুলো নিয়ে গবেষণা-বিশ্লেষণ করলেই তাদের ভূমিকার সঠিক চিত্র উঠে আসবে। – প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব
প্রতিষ্ঠানগুলোতে গণমাধ্যমকর্মীদের অবমূল্যায়নের বিষয় তুলে ধরে শফিকুল আলম বলেন, প্যাশন থেকে যারা সাংবাদিকতা পেশায় আসছে তাদের ঠিক মতো আপনি (মালিকপক্ষ) বেতন দিচ্ছেন না। মফস্বলে অনেকে সাংবাদিকতা করেন, অফিস থেকে তারা দুই হাজার টাকাও বেতন পান না। সাংবাদিকদের উচিত এ নিয়ে জোরালো ভূমিকা রাখা। গার্মেন্টস (তৈরি পোশাক) শিল্পের কর্মীরা ন্যূনতম বেতন আদায় করে নিতে পারলে আপনারা কেন পারবেন না।
সব গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য বিগত সরকারের ছিল। ডিজিএফআইয়ের একটা ফোনকল, এনএসআইয়ের একটা ফোনকল বা ডিবির একটা ফোনকল অথবা মন্ত্রীর একটা ফোনকল যথেষ্ট ছিল। কীভাবে তারা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করত তার অনেক গল্প শুনেছি। ভবিষ্যতে তারা যেন সরাসরি গণমাধ্যমের মুখ বন্ধে এমন ভূমিকা না রাখতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের শুধু গণমাধ্যম বিষয়ক অফিস থাকতে পারে, যেখান থেকে দেখা হবে কোনো গণমাধ্যম ভুল সংবাদ প্রকাশ করছে কিনা। করলে সেটা বলুক। – শফিকুল আলম
সংগঠনের মুখপাত্র প্লাবন তারিকের সভাপতেত্বে সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার আকবর হোসেন, দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক আব্বাস উদ্দিন, উত্তরা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মাহবুব আলম, আইনজীবী মোল্লা মো. ফারুক কায়সার প্রমুখ।
এদের মধ্যে প্রেস মিনিস্টার আকবর হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠান সিআরআই থেকে গণমাধ্যমগুলোতে স্ক্রিপ্ট দেওয়া হতো। পেশাদারত্বের জায়গা থেকে আপস না করে সেসব স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী যারা কাজ করতে পারেননি, এমন অনেক সাংবাদিক চাকরি ছেড়েছেন। এসব যারা করিয়েছেন, এমন মালিকরা এখনও আছেন। বিগত ১৫/১৬ বছরে যারা গণমাধ্যমের মালিক হয়েছেন, কীভাবে হয়েছেন, এসব খতিয়ে দেখা উচিত। এখনও কিছু সাংবাদিক গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে মূলত ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করবেন, তা হবে না।
তিরি আরো বলেন, অনেক মালিক বাইরে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলেন। কিন্তু নিজের প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদের ঠিক মতো বেতন দেন না। বেতনের ন্যূনতম মানদণ্ড ঠিক করা উচিত। গণমাধ্যমগুলোতে অ্যাকাউন্টিবিলিটি নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য প্রসেসগুলো সুচারুরূপে থাকা দরকার। বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে স্যোশাল মিডিয়া পলিসি আছে। আমাদের দেশে কয়টা গণমাধ্যমে এটি আছে? গণমাধ্যম চালাতে হলে মানদণ্ড ঠিক করতে হবে, নয়তো গণমাধ্যম চালাতে পারবেন না।
সভাপতির বক্তব্যে জয়নাল আবেদীন শিশির অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, যারা ফ্যাসিস্ট সরকারের অন্যায়-অপকর্মে ভূমিকা রেখেছেন তাদের আগে চিহ্নিত করুন। তাদেরকে বলছি, আপনারা নিজ থেকে ক্ষমা চান। নয়তো আমরা আপনাদের প্রতিহত করবো। আওয়ামী লীগের মতো মিডিয়া লীগকেও প্রতিহত করতে, উপযুক্ত জবাব দিতে আমরা প্রস্তুত। বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় গণমাধ্যমের যারা ফৌজদারী অপরাধ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান।